নাছরিন জাহান রীতু-ভালবাসার তিক্ততা


: হ্যালো
- হ্যাঁ চারু,বলো।
: কি হলো তোমার? কতক্ষণ ধরে ফোন দিচ্ছি ধরছো না যে?
- আমার ইচ্ছা করেনি তাই ধরিনি,আর কিছু বলবা?
: কেন? তুমি কি বিরক্ত হচ্ছো?
- হ্যাঁ হচ্ছি।
কথাটা বুকের মধ্যে বিঁধে যায় চারুর,আস্তে করে ফোনটা কেটে দেয় সে। গতবছর পহেলা বৈশাখে নীলের সাথে পরিচয় হয় চারুর,এই বছর তাদের সম্পর্কটা এক বছরে পা দেবে।কিন্তু নীলের ব্যাবহারগুলা দিন দিন কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে,ভাবতেই চারুর চোখ টলমল করে উঠে।খুব কষ্ট হয় চারুর,চারু ভাবে কথাগুলো মুন্নাকে বললে হয়তো একটু হালকা হতে পারবে।
ভাবতে ভাবতে চারু মুন্নাকে ফোন দেয়। মুন্না চারুর সবচেয়ে কাছের বন্ধু।চারুর বিপদে আপদে সবসময় পাশে থাকে এই ছেলেটা।মুন্নার মতো এতো ভাল একটা বন্ধু পেয়ে চারু অনেক হ্যাপি।
রিং হতেই ওপাশ থেকে ফোন রিসিভ করে মুন্না।
: হ্যালো চারু
- হুমমমম
: কি ব্যাপার,কি হয়েছে তোর? (ওপাশ থেকে শুধু চারুর ফুঁফিয়ে কান্নার শব্দ পায় মুন্না)
:তুই আবার কাঁদছিস?তোকে না কতোবার বলেছি এভাবে কাঁদবি না,কি হয়েছে বল আমাকে।নীলের সাথে ঝগড়া করেছিস? : নারে মুন্না কিছুনা।
- তাহলে কাঁদছিস কেন?
: এমনিতেই,
(বলেই আবার ফুফিয়ে উঠে চারু) - আমাকে বল চারু।
: নীল যেন কেমন কেমন করে রে,আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারিনা ওকে।
- ওওও,এই কথা? চিন্তা করিস না সব ঠিক হয়ে যাবে, হয়তো কোন কিছু নিয়ে চিন্তিত তাই তোর সাথে একটু..... বাদ দে তো চারু,এই নিয়ে কেউ বাচ্চাদের মতো এভাবে কাঁদে? : এই মুন্না শোন,নীল ফোন দিচ্ছে,রাখি। চারু ফোনটা কেটে দেয়। মুন্নার খুব ইচ্ছা করে এই মায়াবতী মেয়েটার সব চোখের পানি দুহাতে মুছে দিতে। মুন্নার খুব কষ্ট হয় চারুর জন্য,এরকম একটা মেয়েকে কেউ কষ্ট দিতে পারে?
চারু হয়তো কখনো জানতেও পারবেনা ওকে কতোটা ভালবাসে মুন্না। চারুকে কিছু বলার আগেই নীলের সাথে ওর সম্পর্কটা গড়ে উঠে।তারপর থেকেই গোপনে ভালবেসে চলেছে মুন্না এই চারু নামের মায়াবতী কে।
_____
চোখের পানি মুছে তাড়াতাড়ি নীলের ফোনটা রিসিভ করে চারু,ওপাশ থেকে নীলের কণ্ঠ শোনা যায়_
- হ্যালো বাবুই
: হ্যাঁ বলো
- তুমি এতো পাগলি কেন বাবুই?কিছু বললেই মন খারাপ করে কান্নাকটি শুরু করে দাও। আমি যে তোমার কান্না সহ্য করতে পারিনা। : তাহলে আমাকে এতো কষ্ট দাও কেন? - আমি তোমাকে কখন কষ্ট দিলাম! ঠিক আছে বাবুই এই যে কানে ধরছি আর কষ্ট দিবোনা।
চারুর ঠোটের কোনে এক
চিলতে হাসি ফুটে উঠে।কেন জানি এই ছেলেটার উপর রাগ করে থাকতে পারেনা চারু। একটু ভাল কথা বললেই সব কষ্ট ভুলে যায়। এদিকে নীলের মাথাটা যন্ত্রণায় ফেটে যাচ্ছে মনে হয়।প্রতিবার চারুকে কষ্ট দেওয়ার পর এই অবস্থা হয় তার।চারুর সাথে অকরণে কেন যে এমটা করে তা নীল নিজেও জানেনা।চারুকে যতোটা কষ্ট দেয় তার থেকে বেশী কষ্ট নীল পায়।বুকের ভেতরটা কেমন যেন দলা পাকিয়ে যায়।নীল তো কম ভালবাসেনা চারুকে,তাহলে কেন সে কষ্ট দেয় মেয়েটাকে?
আর কিছু ভাবতে পারেনা নীল। হ্যাঁ,কিছু একটা করতে হবে।এভাবে আর কষ্ট পেতে দেবেনা চারুকে।
____
আজ ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখ। চারদিকে বৈশাখী আমেজ।মুন্না বারান্দায় বসে ভাবছে অন্য কথা,একটু আগে চারু আবার ফোন করেছিলো,এমন একটা দিনেও মেয়েটা কাঁদছে।
আচ্ছা,আজ বিকালে চারুকে নিয়ে একটু মেলা থেকে ঘুরে আসলে কেমন হয়? হয়তো ওর মনটা একটু
ভালো হবে,তা নাহলে তো সারাদিন মন খারাপ করেই থাকবে মেয়েটা।
এখন ওর মন খারাপ তাই বিকালে ফোন করে চারুকে বলতে হবে মেলায় যাওয়ার কথা। মনে মনে কথাগুলো ভাবে মুন্না। বিকাল ৪টা বেজে ১৫মিনিট।চারু রুম থেকে বের হতে যেয়েও আরো একবার আয়নায় নিজেকে দেখে।আয়নায় দেখে চারুর নিজেরই লজ্জা লাগে।
চারু কখনোই সাজুগুজু করেনা।কিন্তু আজ শুধু নীলের অনুরোধেই সেজেছে চারু।বৈশাখ উপলক্ষে নীলের
দেওয়া শাড়িটা পরেছে,নিজের এই রুপ চারু আগে কখনো দেখেনি।
রুমের দেওয়াল ঘড়িটার উপর চোখ পড়তেই হন্তদন্ত হয়ে রুম
থেকে বেরিয়ে আসে চারু,মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাসা থেকে বের হয় চারু। নিচে নেমে একটাও রিক্সা/সিএনজির দেখা পায়না চারু।আজ পহেলা বৈশাখ তাই হয়তো সবকিছুর এতো কমতি।উপায় না পেয়ে হাটতে থাকে চারু,গন্তব্য নদীর পাড় যেখানে নীল অপেক্ষা করছে।হঠাত্ ফোনটা বেজে উঠে,চারু ফোনটা বের করে দেখে মুন্না ফোন করেছে_
: হ্যালো মুন্না, বল
- একটা কথা বলবো চারু?
: হ্যাঁ বল
- একটু বের হবি? তোকে মেলায় নিয়ে যেতাম। : আরে না,আমি তো নীলের
সাথে ঘুরতে যাচ্ছি,বাসা থেকে বের হয়েছি মাত্র।
- আচ্ছা,ঝগড়া মিটে গেছে?
: হ্যাঁ।জানিস তো নীল
আমাকে কতোটা ভালবাসে।
- ওকে যা,সাবধানে যাস দোস্ত। : হুম,টা টা।
ফোন কেটে দেয় চারু,মুন্না শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বিকাল ৫টা।চারু আর নীল বসে আছে নদীর পাড়ে,নীল আজ
একটা সাদা পাঞ্জাবি পরে এসেছে। নীরবতা ভাঙে চারু,
কি ব্যাপার নীল?মেলায় না যেয়ে আজ এখানে আসতে বললে যে?
নীল: আজ
তোমাকে এখানে আসতে বলেছি কারণ তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে,যা তুমি কল্পনাও করতে পারবে না। চারু: কি সারপ্রাইজ গো? আমার তো আর দেরি সহ্য হচ্ছে না।
নীল: ঠিক আছে আমার চারুলতা,এবার উঠোতো,হাটতে হাটতে সবকিছু বলতেছি। দুজনেই হাটতে শুরু করলো। নদীর পাড়টা আজ একেবারে নির্জন। এমনিতেও এদিকে লোকজন তেমন আসেনা,মাঝে মাঝে দু চার জন যা দেখা যায় আজ তাও নেই।
জানো চারু আজ তোমাকে অনেক সুন্দর লাগছে,মনে হচ্ছে কোন পরী ভুল করে আকাশ থেকে জমিনে নেমে এসেছে। চারুর মুখ দেখে মনে হলো খুব লজ্জা পেয়েছে।
চারু তোমার মনে আছে,গতবছর এইদিনে এই নদীর পাড়ে তোমাকে আমি প্রথম দেখেছিলাম?
হ্যাঁ মনে আছে তো।তুমি ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে ছিলে আমার দিকে,হিহিহি। নীল তাকিয়ে থেকে চারুর মুখের দিকে। কি নিষ্পাপ হাসি,কি মায়াবী একটা চেহারা,আর এই মেয়েটাকে সে দিনের পর দিন কষ্ট দিয়ে আসছে,অথচ কোন অভিযোগ নেই চারুর, কিভাবে সহ্য করে?
কি হলো নীল? কি ভাবছ?
কৈ,কিছু না তো।
আচ্ছা চারু তুমি এতো ভালো কেন? - কে বলেছে আমি ভালো,আমি তো অনেক পচা।
চারু আমি যে তোমার সাথে খারাপ ব্যাবহার করি,তোমার অনেক কষ্ট হয় তাইনা? - হ্যাঁ হয়,কিন্তু তুমি যখন একটু ভালবাসো তখন সব কষ্ট ভুলে যাই। আমি তো জানি তুমি আমাকে খুব ভালবাসো। নীল চারুর চোখের
দিকে তাকায়,না ওখানে সরলতা ছাড়া আর কিছুই নেই।
-কি হলো নীল সারপ্রাইজটা কি? - হ্যাঁ,এদিকে আসো তো,এইখানে চোখ বন্ধ করে দাড়াও,
-আচ্ছা এইযে চোখ বন্ধ করে দাড়ালাম। আমি না বলা পর্যন্ত চোখ খুলবে না কিন্তু। - আচ্ছা বাবা ঠিক আছে।
নীল আলতো করে চারুর হাতটা ধরে বলে,এই তোমার হাত ধরে কথা দিলাম আজকের পর তোমার আর কষ্ট পেতে হবে না।এবার নীল শেষ বারের মতো চারুর মুখের দিকে তাকায়। চোখ বন্ধ করে পরম নিশ্চিন্তে হাসি মুখে দাড়িয়ে আছে মেয়েটা। - কি হলো নীল? আর কতক্ষণ এভাবে দাড়িয়ে থাকবো? কোথায় তুমি নীল? চারুর ডাকে সম্বিত ফিরে পায় নীল,ঝটপট চারুর পিছনে চলে আসে,তারপর ঝুপ করে পানিতে কিছু একটা পড়ার শব্দ হয়।নীল জানে চারু সাতার জানে না। পানির মধ্যে বাঁচার জন্য নিষ্ফল চেষ্টা করে চারু,আস্তে আস্তে পানিতে শব্দ থেমে আসে আর তার
সাথে হারিয়ে যেতে থাকে চারু। _____
মুন্নার ফোনটা বালিশের নিচে শব্দ করে বেজে চলেছে।এতো ভোরে কে ফোন দিলো আবার,চোখ বন্ধ করেই ফোনটা রিসিভ করে মুন্না।
: হ্যালো কে?
- মুন্না আমি দিশা।
: হ্যাঁ দিশা বল,এতো সকালে ফোন দিলি যে? - আমাদের চারু সুইসাইড করেছে রে মুন্না। এরপরের কথাগুলো আর মুন্নার কানে পৌছায় না।একটু ধাতস্থ হতেই দৌড় শুরু করে,উদ্দেশ্য চারুদের বাসা। বাসার নিচে অনেক মানুষের ভিড়,ভিড় ঠেলে সামনে এগিয়ে যায় মুন্না,গিয়ে যা দেখে তাতে কিছুক্ষণের জন্য মাথাটা ফাকা হয়ে যায়।মেয়েটার মুখ দেখে মনে হচ্ছে এখনো হাসছে,এখনি হয়তো উঠে বসবে। পরনে বৈশাখী শাড়িটা ভিজে গায়ে লেপ্টে আছে,হাতে লাল রঙের রেশমি চুরি,চুল
থেকে এখনো পানি ঝরছে। চেহারা থেকে যেন এক ধরনের দ্যুতি ছড়াচ্ছে যাতে মুন্নার চোখ ঝলসে যাচ্ছে।
ওখানে আর এক মুহূর্ত দাড়ায় না মুন্না। এখনো অনেক কাজ বাকি।মুন্না জানে তার কি করতে হবে।
______
নীলের মেসের ঠিকানা আগে থেকেই জানে মুন্না।মুন্না এখন বসে আসে নীলের বাসার নিচে চায়ের দোকানে।বেশিসময় অপেক্ষা করতে হলো না মুন্নার,দূর থেকে নীলকে আসতে দেখে উল্টো দিকে ঘুরে দাঁড়াল মুন্না,যেন নীল তাকে দেখতে না পায়। নীল এতোটাই অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটছ যে একটা জলজ্যান্ত মানুষ তার পিছু নিয়েছে এটা সে টেরই পায়নি। নীল তার রুমের সামানে দাড়িয়ে খুব দ্রুত রুমের তালা খুলছে,হঠাত্ মাথার পিছনে একটা আঘাতে নীলের সবকিছু অন্ধকার হয়ে আসে।
চোখে মুখে পানির ঝাপটা পেয়ে জ্ঞান ফিরে নীলের,সে ভাবে এতক্ষণ তার সাথে কি হলো? সে তো নিজের রুমেই আছে,তাহলে.....?
নীল উঠে বসতে যায়,কিন্তু পারেনা কে যেন তার হাত পা খুব শক্ত করে বেধে রেখেছে। নীল বুঝতে পারেনা এসব কি হচ্ছে তার সাথে। নীলের মনের কথা বুঝতে পেরেই যেন সামনে আসে মুন্না,মুন্নাকে দেখে নীল চমকে উঠে।তাহলে কি মুন্নাই এসব করেছে? নীলের ভাবনায় ছেদ পড়ে মুন্নার কথায়,মুন্নার চেহারায় হিংস্রতা,যেন সবকিছু ধ্বংস করে ফেলবে।
নীলের
দিকে ঝুঁকে মুন্না জিজ্ঞাসা করে_চারুকে কি করেছিস? নীল: আমি জানিনা।আর
তুমি আমাকে এভাবে বেধে রেখেছ কোন সাহসে? আমার বাধন খুলে দাও। মুন্না:তুই
না জানলে কি হবে আমি তো জানি,তুই আমার চারুকে মেরেছিস।বল কেন করলি এরকম? জবাব দে?
নীল:আমি চারুর ব্যাপারে কিছুই জানিনা। এবার আর মুন্না নিজেকে ধরে রাখতে পারেনা। দড়ি দিয়ে নীলের গলাটা পেঁচিয়ে ধরে। তুই বল আমার চারুর কি হয়েছে? মেরেছিস ওকে?
এবার মুখ খুলে নীল,
হ্যাঁ চারুকে আমি মেরেছি, ধাক্কা দিয়ে নদীতে ফেলে দিয়েছি ওকে। আমি আর কি করতাম।ও যে আমার থেকে কষ্ট ছাড়া কিছুই পায়নি।ওর কষ্ট আমার সহ্য হয়না,তাইতো ওকে সব কষ্ট থেকে মুক্তি দিয়ে দিয়েছি। মুন্নার চোখ থেকে টপটপ
করে পানি ঝরছে,নীলকে আর কিছু বলার সুযোগ দেয়না ,গলার দড়িটা গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে দুদিকে টান দেয় মুন্না,হাত পা বাধা থাকায় নীলের কিছু করার থাকেনা,আস্তে আস্তে নীলের দেহটা নিথর হয়ে যায়।
নীলের বাসা থেকে বের হওয়ার আগে আর একবার তাকায় মুন্না,নীলের দেহটা ফ্যানের সাথে ঝুলে আছে আর টেবিলের উপর লেখা একটা নোট_
"চারুকে আমি মেরেছি ওর মৃত্যুর জন্য আমি দায়ী,তাই নিজে আত্মহত্যা করলাম" মুন্না খুব দ্রুত হাঁটছে,চারুর জানাজা পড়তে হবে যে
 ফেসবুক লিংক-https://www.facebook.com/nasrin.jahanritu.12