সকাল
বেলা ঘুম থেকে উঠিয়া নবু মিয়াঁর মেজাজটা বিগড়াইয়ে গেল । উঠানে দাঁড়াইয়া উচ্চ
কণ্ঠে হাঁক-ডাক ছাড়িতে লাগিল-
~ কৈ গেলীরে ? ময়নার মা । তোরে না রাইতে কইছি পান্তা রাখবার জন্যি ।
~ কেমনে রাখুম , রাইতে দুই ফুঁটি চাইল ছিল তাও শেষ । ঘরে আর বাড়তি চাইল নাই ।
~ শালী , ঘরে বইসা খালি চাইল চাবাস । মেশিন হইয়া গেছোস ।
নবু মিয়াঁ উঠানে ঠায় দাঁড়াইয়া থাকা বউয়ের চূলের গুছা ধরে হ্যাঁচকা টান দিয়ে মাটিতে ফেলিয়া মনের খেয়াল মত উহাকে চাপড়াইয়া পৈশাচিক আনন্দ লাভ করিতে উদ্যত হইতেছিল , এমতাবস্থায় ৯ বছরের মাইয়াটা চোখ মুখ কচলাইতে কচলাইতে উঠানের দিকে অগ্রসর হইল । বাপ-মাইয়ার চোখা-চোখি হইতেই নবু মিয়াঁ লজ্জিত হইয়া উহাকে ছাড়িয়া দিল ।
~ বাপজান , তুমি আইজকাও মায়ের গায়ে হাত তুলছ ? তোমার শরম করে না ?
নবু মিয়াঁ আদরের মাইয়ার কথা শুনিয়া আরেক পশলা লজ্জিত হইল । কিছু বলার মত ভাষা সে খুঁজিয়া পাইল না । শুধু লজ্জায় তাহার চক্ষুদ্বয় রক্ত বর্ণ হইয়া উঠিল ।
~ বাপজান আইজকা কিন্তুক নুপুর কিন্যা আনন লাগব ।
মাইয়ার একজোড়া নুপুরের খুব শখ । গরিবের ঘরে জন্মিয়াছে বলিয়া কি উহার কোন সাধ আল্লাদ থাকিতে পারে না ? নবু মিয়াঁ পরাজিত সৈনিকের মত উহার দিকে তাকাইয়া থাকিল । কষ্টে তাহার ঠোঁট জোড়া কাঁপিতেছিল ।
হত দরিদ্র নবু মিয়াঁর সম্পত্তি বলিতে ভিটে মাটি আর বাপ-দাদার আমলের একটা কাঠের ডিঙি নৌকা । যা দিয়া বরষার মৌসুমে লোকজন পারাপার করিয়া দিন যাপন করিতে হয় । নদী শুঁকিয়ে আসার সাথে সাথে নবু মিয়াঁর জীবনেও খরা ডাকিয়া আনিতেছে । মেজাজটাও সবসময় রুক্ষ থাকে ।তাই হয়তো অন্যের উপর রাগ ঝাড়িতে না পারিয়া বউকে মারিয়া মেজাজ ঠিক রাখিবার চেষ্টা । দুধের সাধ ঘুলে মেটানো , আর কি ?
সেদিন গঞ্জে গিয়া মোড়ল সাহেবের নিকটে কিছু টাকা চাহিতেই তিনি একটা সাদা কাগজে টিপ সই রাখিয়া তাহাকে টাকা দিল । নবু মিয়াঁ গঞ্জের দোকান থেকে একজোড়া রূপোর নুপুর খরিদ করিয়া বাড়ির পথে হাঁটা দিল । মাইয়াডা নুপুর দেখিয়া কি যে খুশী হইল তা বুঝিয়ে বলা মুশকিল । সারা ঘরময় নুপুরের রিনিঝিনি শব্দ বাজিতে লাগিল । সেই সাথে নবু মিয়াঁর মনটাও সুখের পরশে নাচিয়া উঠিল ।
অভাবের সংসারে আবারও নতুন অতিথির আগমনের লক্ষণ প্রকাশ পাইতেছে । নবু মিয়াঁর স্ত্রী পরিবার পরিকল্পনার এক গাদা পিল হজম করিয়াও উপর ওয়ালার ইচ্ছাকে ঠেকাইতে না পারিয়া হাল ছাড়িয়া সংসারে লোক বাড়াইবার চক্রান্ত করিতেছে । দিন দিন তাহার উদর ও পিঠ ধনুকের মত বক্র হইয়া ফুলিয়া ফাঁপিয়া উঠিতেছে ।
সেদিন নবু মিয়াঁর মাইয়াডা নুপুরের রিনিঝিনি শব্দ তুলিয়া খাল পাঁড়ের পথে যাইতেছিল । উহাকে দেখিয়া মোড়লের বখাটে ছেলেটা আশে পাঁশে লোকজন না দেখিয়া জোর করিয়া মাইয়াটাকে ধরিয়া পাশবিক নির্যাতন করিতে থাকিল , নির্যাতনের মাত্রা এতই ছিল যে মাইয়াটার নড়িবার সাহস পর্যন্ত হইল না । সারা গাঁয়ে খবরটা কেমন করিয়া জানি রটিয়া গেল । লজ্জা আর ঘৃণা সইতে না পারিয়া মাইয়াটা গলায় যখন দড়ি দিয়ে মারা গেল সেদিন নবু মিয়াঁ শোঁকে পাঁথর হইয়া গিয়াছিল । মোড়লের লোকজন বাড়িতে আসিয়া শাসাইয়া গেল যাহাতে সে মুখ খুলিতে না পারে ।
দুঃখের ঘা যখন শুকানোর উপক্রম হইতেছিল তখনি আরেকটা দুরসংবাস নবু মিয়াঁর দরজায় আসিয়া কড়া নাড়িতে লাগিল । নৌকার গলুইয়ের উপর বসিয়া নবু মিয়াঁ তামাক টানিতেছিল এমন মুহূর্তে ফকিরের মা আসিয়া খবর দিল যে তাহার বৌ আবারও কন্যা সন্তান প্রসব করিয়াছে । নবু নিয়া নড়িল না ঠায় বসিয়া থাকিল । হঠাত তাহার মথায় বিদ্যুৎ চমকাইয়া উঠিল আর সোজা বাড়ির দিকে দৌড়াইতে লাগিল । বাড়িতে আসিয়া সদ্য ভূমিষ্ঠ বাচ্চাটাকে বৌয়ের কোল থেকে লইয়া তাহার উদর বরাবর একটা লাথি দিয়া নদীর দিকে দৌড়াইতে লাগিল । দাঁই নবু মিয়াঁর ভাব বুঝিতে পারিয়া তাহার পিছন পিছন দৌড়াইতে লাগিল কিন্তু উহাকে আটকাইতে সমর্থ হইল না । বাচ্চা টাকে লইয়া সে নৌকায় উঠিয়া মাঝ নদীর পথে যাত্রা করিল । উহাকে নৌকার পাটাতনের সাথে বাঁধিয়া নৌকার মাঝখানে ছিদ্র করিয়া নিজেকে নৌকার সাথে বাঁধিয়া লইল । আস্তে আস্তে নৌকায় পানি উঠিতে লাগিল আর নৌকা ডুবিয়া যাইতে থাকিল । দাইয়ের হাঁক ডাকে অনেকেই নদীর পাঁড়ে জড় হইল কিন্তু নবু মিয়াঁ কাহারও ডাকে কর্ণপাত করিল না । অবশেষে নৌকা মাঝ নদীতে তলাইয়া গেল । সেই সাথে উপসংহার রচিত হইল নবু মিয়াঁর জীবন সংসারের ।
~ কৈ গেলীরে ? ময়নার মা । তোরে না রাইতে কইছি পান্তা রাখবার জন্যি ।
~ কেমনে রাখুম , রাইতে দুই ফুঁটি চাইল ছিল তাও শেষ । ঘরে আর বাড়তি চাইল নাই ।
~ শালী , ঘরে বইসা খালি চাইল চাবাস । মেশিন হইয়া গেছোস ।
নবু মিয়াঁ উঠানে ঠায় দাঁড়াইয়া থাকা বউয়ের চূলের গুছা ধরে হ্যাঁচকা টান দিয়ে মাটিতে ফেলিয়া মনের খেয়াল মত উহাকে চাপড়াইয়া পৈশাচিক আনন্দ লাভ করিতে উদ্যত হইতেছিল , এমতাবস্থায় ৯ বছরের মাইয়াটা চোখ মুখ কচলাইতে কচলাইতে উঠানের দিকে অগ্রসর হইল । বাপ-মাইয়ার চোখা-চোখি হইতেই নবু মিয়াঁ লজ্জিত হইয়া উহাকে ছাড়িয়া দিল ।
~ বাপজান , তুমি আইজকাও মায়ের গায়ে হাত তুলছ ? তোমার শরম করে না ?
নবু মিয়াঁ আদরের মাইয়ার কথা শুনিয়া আরেক পশলা লজ্জিত হইল । কিছু বলার মত ভাষা সে খুঁজিয়া পাইল না । শুধু লজ্জায় তাহার চক্ষুদ্বয় রক্ত বর্ণ হইয়া উঠিল ।
~ বাপজান আইজকা কিন্তুক নুপুর কিন্যা আনন লাগব ।
মাইয়ার একজোড়া নুপুরের খুব শখ । গরিবের ঘরে জন্মিয়াছে বলিয়া কি উহার কোন সাধ আল্লাদ থাকিতে পারে না ? নবু মিয়াঁ পরাজিত সৈনিকের মত উহার দিকে তাকাইয়া থাকিল । কষ্টে তাহার ঠোঁট জোড়া কাঁপিতেছিল ।
হত দরিদ্র নবু মিয়াঁর সম্পত্তি বলিতে ভিটে মাটি আর বাপ-দাদার আমলের একটা কাঠের ডিঙি নৌকা । যা দিয়া বরষার মৌসুমে লোকজন পারাপার করিয়া দিন যাপন করিতে হয় । নদী শুঁকিয়ে আসার সাথে সাথে নবু মিয়াঁর জীবনেও খরা ডাকিয়া আনিতেছে । মেজাজটাও সবসময় রুক্ষ থাকে ।তাই হয়তো অন্যের উপর রাগ ঝাড়িতে না পারিয়া বউকে মারিয়া মেজাজ ঠিক রাখিবার চেষ্টা । দুধের সাধ ঘুলে মেটানো , আর কি ?
সেদিন গঞ্জে গিয়া মোড়ল সাহেবের নিকটে কিছু টাকা চাহিতেই তিনি একটা সাদা কাগজে টিপ সই রাখিয়া তাহাকে টাকা দিল । নবু মিয়াঁ গঞ্জের দোকান থেকে একজোড়া রূপোর নুপুর খরিদ করিয়া বাড়ির পথে হাঁটা দিল । মাইয়াডা নুপুর দেখিয়া কি যে খুশী হইল তা বুঝিয়ে বলা মুশকিল । সারা ঘরময় নুপুরের রিনিঝিনি শব্দ বাজিতে লাগিল । সেই সাথে নবু মিয়াঁর মনটাও সুখের পরশে নাচিয়া উঠিল ।
অভাবের সংসারে আবারও নতুন অতিথির আগমনের লক্ষণ প্রকাশ পাইতেছে । নবু মিয়াঁর স্ত্রী পরিবার পরিকল্পনার এক গাদা পিল হজম করিয়াও উপর ওয়ালার ইচ্ছাকে ঠেকাইতে না পারিয়া হাল ছাড়িয়া সংসারে লোক বাড়াইবার চক্রান্ত করিতেছে । দিন দিন তাহার উদর ও পিঠ ধনুকের মত বক্র হইয়া ফুলিয়া ফাঁপিয়া উঠিতেছে ।
সেদিন নবু মিয়াঁর মাইয়াডা নুপুরের রিনিঝিনি শব্দ তুলিয়া খাল পাঁড়ের পথে যাইতেছিল । উহাকে দেখিয়া মোড়লের বখাটে ছেলেটা আশে পাঁশে লোকজন না দেখিয়া জোর করিয়া মাইয়াটাকে ধরিয়া পাশবিক নির্যাতন করিতে থাকিল , নির্যাতনের মাত্রা এতই ছিল যে মাইয়াটার নড়িবার সাহস পর্যন্ত হইল না । সারা গাঁয়ে খবরটা কেমন করিয়া জানি রটিয়া গেল । লজ্জা আর ঘৃণা সইতে না পারিয়া মাইয়াটা গলায় যখন দড়ি দিয়ে মারা গেল সেদিন নবু মিয়াঁ শোঁকে পাঁথর হইয়া গিয়াছিল । মোড়লের লোকজন বাড়িতে আসিয়া শাসাইয়া গেল যাহাতে সে মুখ খুলিতে না পারে ।
দুঃখের ঘা যখন শুকানোর উপক্রম হইতেছিল তখনি আরেকটা দুরসংবাস নবু মিয়াঁর দরজায় আসিয়া কড়া নাড়িতে লাগিল । নৌকার গলুইয়ের উপর বসিয়া নবু মিয়াঁ তামাক টানিতেছিল এমন মুহূর্তে ফকিরের মা আসিয়া খবর দিল যে তাহার বৌ আবারও কন্যা সন্তান প্রসব করিয়াছে । নবু নিয়া নড়িল না ঠায় বসিয়া থাকিল । হঠাত তাহার মথায় বিদ্যুৎ চমকাইয়া উঠিল আর সোজা বাড়ির দিকে দৌড়াইতে লাগিল । বাড়িতে আসিয়া সদ্য ভূমিষ্ঠ বাচ্চাটাকে বৌয়ের কোল থেকে লইয়া তাহার উদর বরাবর একটা লাথি দিয়া নদীর দিকে দৌড়াইতে লাগিল । দাঁই নবু মিয়াঁর ভাব বুঝিতে পারিয়া তাহার পিছন পিছন দৌড়াইতে লাগিল কিন্তু উহাকে আটকাইতে সমর্থ হইল না । বাচ্চা টাকে লইয়া সে নৌকায় উঠিয়া মাঝ নদীর পথে যাত্রা করিল । উহাকে নৌকার পাটাতনের সাথে বাঁধিয়া নৌকার মাঝখানে ছিদ্র করিয়া নিজেকে নৌকার সাথে বাঁধিয়া লইল । আস্তে আস্তে নৌকায় পানি উঠিতে লাগিল আর নৌকা ডুবিয়া যাইতে থাকিল । দাইয়ের হাঁক ডাকে অনেকেই নদীর পাঁড়ে জড় হইল কিন্তু নবু মিয়াঁ কাহারও ডাকে কর্ণপাত করিল না । অবশেষে নৌকা মাঝ নদীতে তলাইয়া গেল । সেই সাথে উপসংহার রচিত হইল নবু মিয়াঁর জীবন সংসারের ।