আরিফুল হক হিমেল-অন্ধকারের গল্প

বাস থামতেই গরমের একটা হলকা এসে ধাক্কা দিল আনিসকেএতোক্ষন গায়ে বাতাস লাগার কারনে গরমটা তেমন বোঝা যায়নি কিন্তু এখন উত্তাপটা বেশ ভালোই টের পাচ্ছেসামনের দিক থেকে লোকজন নেমে যাচ্ছে,আনিসও তার ব্যাগটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ায় নামার জন্যবাসের সিট ধরে ধরে গেটের দিকে এগিয়ে যায়
আনিস এই প্রথম কোন বড় শহরে আসলবছরখানেক আগে ইন্টার পাশ করে বসে আছে গ্রামে থাকতে অবশ্য সবাই পড়ার জন্য চাপ দিচ্ছিল কিন্তু আনিস আর ও ঝামেলায় যায়নিআনিসের ছোটবেলার বন্ধু রফিক অনেকদিন ধরেই শহরে থাকেসেই মেট্রিকের টেস্টে ফেল করে বাড়ি থেকে পালিয়েছিল,সেই আসাতেই আসাতার প্রায় বছরখানেক পর অবশ্য বাড়ি ফিরেছিল কিন্তু আর মন টেকাতে পারে নিরফিক এখন ঢাকাতেই থাকে,বছরে দুএকবার বাড়িতে যায়

আনিস ঢাকা এসেছে রফিকের কাছেবেড়ানোর জন্য না,একেবারে পাকাপাকিভাবে থাকার জন্যআসার আগে অবশ্য সে রফিকের ঠিকানা যোগার করেছে কিন্তু তার আসার খবর রফিকে না জানানোটা বোকামি হয়ে গেছেএখন এই ঠিকানা খুঁজে বের করাই মুশকিল হয়ে যাবে
আনিস বাস থেকে নেমে রাস্তার পাশে অনেকক্ষন ধরে দাঁড়িয়ে আছে
সে এখন মোটামুটি বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে আছেরিক্সাওয়ালারা বেশ খানিকক্ষন তাকে নিয়ে টানাটনানি করার পর ফাঁকা মাল বুঝতে পেরে চলে গেছে ঠিকানা লেখা কাগজটা হাতে নিয়ে সে একটা রিক্সার কাছে এগিয়ে যায়
আনিস কাগজটা রিক্সাওয়ালার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে:
এই ঠিকানায় যেতে পারবেন?
পারমু
কত টাকা ভাড়া?
দিয়েন ৩০ টাকা
কথা না বাড়িয়ে আনিস রিক্সায় ওঠেরিকশায় ওঠার সময় সে পকেটে হাত দিয়ে টাকার ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে নেয়
আনিস বাড়ি থেকে তার জমানো ৪০০ টাকা নিয়ে বেরিয়েছিল
তার মা অবশ্য তাকে আরও কিছু টাকা দিতে চেয়েছিল কিন্তু আনিস নেয় নি কিভাবে নেবে,তার এখন আয়-রোজগার করে বাড়িতে টাকা দেবার কথা উল্টো তাকে মায়ের কাছ থেকে নিতে হচ্ছে! লজ্জার ব্যাপার না?
রিকশাটা তাকে একটা ঘুপচি গলির সামনে নামিয়ে দিয়ে যায়আনিস রিকশা থেকে নেমে গলির মধ্যে এগিয়ে যায়গলিটা চাপাদুজন মানুষ একসাথে যাওয়া মুশকিল গলির সাথে লাগোয়া বাড়িগুলোর দেওয়ালের রং শ্যওলা পড়ে কালচে সবুজ বর্ণ ধারন করেছেগলির শেষ মাথায় একতলা একটা বাড়িবাড়ি বলতে অতিকষ্টে দাঁড়িয়ে থাকা ইট-সুরকির কংকাল
বাড়ির সামনে কাঠের কয়েকটা চেয়ারে কিছু লোক বসে আছেআনিস সেখানে গিয়ে কাগজটা এগিয়ে দিয়ে রফিকের কথা জিজ্ঞেস করে
একটা লোক হাত বাড়িয়ে কাগজটা নেয়আনিসের প্রশ্ন শুনে লোকগুলো এমনভাবে তাকায় যেন কথাটা জিজ্ঞেস করা চরম অপরাধ হয়ে গেছেকাগজটা ফিরিয়ে দিতে দিতে লোকটা আনিসকে উপর-নীচ কয়েকবার
দেখে তারপর গলায় ঝোলানো খিলানটা দিয়ে বিশ্রীভাবে দাঁত খিলান করতে করতে আনিসকে জিজ্ঞেস করে,রফিক কি লাগে?
আনিস কাধের ব্যাগটা ঝাঁকি দিয়ে ভালভাবে ঝুলিয়ে নিয়ে বলে,বন্ধু
এক গ্রামে বাড়ি
লোকাটা আনিসের পায়ের সামনে মাটিতে কয়েক দলা থুথু ফেলে বলে, অঅওওতারপর পিছনের দিক ঘুরে ডাক দেয়,মইজন্য! বাইরে আয়ভিতর থেকে বেটে কালো একটা লোক বেরিয়ে আসে
লোকটা আনিসের দিকে তাকিয়ে বলে,হ্যারে রফিকের ঘরে নিয়া যা
বেটে লোকটা আনিসকে সামনের দিকে ইশারা করে বলে,আসেন
বেটে লোকটা আনিসকে বিল্ডিংটার ভিতরে নিয়ে যায়
বিল্ডিংয়ের ভিতরে আলো কমআনিসের চোখ সয়ে আসতে সময় লাগেএকটু এগিয়ে একটা দরজার সামনে গিয়ে মাজায় ঝোলানো চাবি দিয়ে দরজাটা খুলে মজনু ভিতরে প্রবেশ করে
আনিসও মজনুর পিছনে ঘরের ভিতর ঢোকেঘরের ভেতরটা আরো অন্ধকারদীর্ঘদিন ঘর বন্ধ থাকলে যেমন ভ্যাপসা গন্ধ বের হয় তেমন গন্ধ আসছেঘরের উওর দিকে একটা ভাঙ্গা জানালাসেটাতে চট ঝোলানো মজনু গিয়ে চটটা সরিয়ে দেয়,বাইরের কড়া রোদ ঘরের ভিতর প্রবেশ করেআনিসের শরীর গরমে চিরচির করতে থাকে
মজনু কোথায় যেন হাত দিয়ে সুইচ টিপে দেয়মাথার উপর ক্যারক্যার শব্দে অলস ভঙ্গিতে একটা ময়লাধরা ফ্যান ঘুরতে থাকে
দরজার সামনে গিয়ে আনিসের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে মজনু বলে,আপনে আরাম করেনরফিক ভাই আইসা পড়বো
মজনু চলে যাওয়ার পর আনিস তার ব্যাগটা নীচে রেখে খাটের উপর বসেখাটটা পুরনো হলেও বিছানার চাঁদরটা সুন্দর করে বিছানো
একদম টানটান,যেটা এ বাড়ির পরিবেশের সাথে একেবারেই যায় নাাগরমে গায়ের জামাটা ভিজে যাচ্ছেফ্যানের বাতাসটাও অসহ্য লাগছে
চোখে মুখে একটু পানি লাগালে ভাল হতো কিন্তু এখানে সে পানি পাবে কোথায়বসে থাকতে থাকতে আনিসের ঝিমুনি এসে যায়
শুয়ে পড়ে শুয়ে শুয়ে কত কি মনে হয়গরমের দুপুরে গ্রামের পুকুরে সাতার কাটার কথা মনে হয়
তার বাবর কথাও মনে হয়,আজ বাবা থাকলে তাকে নিশ্চয়ই এখানে আসতে হতো না গ্রামেই দাপিয়ে বেড়াতে পারতবুকে একটা চাপা কষ্ট ভর করেভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ে আনিস
সন্ধ্যার দিকে আনিসের ঘুম ভাঙ্গেঘুম ভাঙ্গার পর কেন জানি তার নিজের কাছেই লজ্জা লাগছেরাতে রফিকের সাথে দেখা হয়একি চেহারা হয়েছে তার চোখমুখ শুকিয়ে গেছেবাল্বের টিমটিমে লালচে আলোয় ভালভাবে দেখা না গেলেও বেশ বোঝা যাচ্ছে যে,সে আগের চেয়ে অনেক শুকিয়ে গেছেআনিসকে দেখে রফিক তেমন একটা অবাক হলো, না মনে হচ্ছে তার আসার ঘটনা প্রায় প্রতিদিনি ঘটে
আনিসকে নিয়ে রফিক বাইরে হোটেলে খেতে যায়হোটেলটা বেশ খানিকটা দূরে ওরা কথা বলতে বলতে হাঁটেরফিক গ্রামের সবার কথা জিজ্ঞেস করেওর মা-বাবা,বোনের কথা জিজ্ঞেস করেরফিক মুখ হাসি হাসি করে কথা বললেও তার কন্ঠে যে আফসোস ঝরে পড়ে তা বোঝা যায়হোটেল থেকে খেয়ে ফেরার সময় রফিক বলল,এসেছিস ভালই করেছিসতোর কোন চিন্তা নেইআরামে খাবি আর ঘুমাবিকলেজে ভর্তি হবার ইচ্ছা থাকলেও বল,ব্যবস্থা করে দিব
নারে,লেখাপড়া আর আমাকে দিয়ে হবে নাতুই বরং আমাকে চাকরি-বাকরি কিছু যোগাড় করে দে!
ঠিক আছে থাক কয়েকদিন,ব্যবস্থা একটা হয়ে যাবে
আচ্ছা,তুই কি করিস?
আমার কি আর কাজের ঠিক আছেযখন যেটা পাই,ওটাই চালিয়ে দেই
কথা বলতে বলতে ওরা গলির ভেতর ঢুকে পড়েঅন্ধকার হলেও রফিক বেশ তাড়াতাড়িই হাঁটছে,বোঝা গেল এ গলিতে অন্ধকারে চলাফেরায় ও বেশ অভ্যস্থ
পরদিন খুব সকালে আনিসের ঘুম ভাঙ্গেরফিক তখনও মরার মতো ঘুমচ্ছেআনিস ভাঙ্গা জানালাটার কাছে এসে দাঁড়ায়চটটা সরিয়ে বাইরে মাথা গলিয়ে দেয়এখনও তেমন আলো ফোটেনি,চারদিকে ঝাপসা অন্ধকারে ঢেকে আছে
আনিস কাছে পিঠে কোন বাড়ি-ঘর দেখতে পায় নাসামনে একটা পুকুরওপাশে কয়েকটা ছোট ছোট বিল্ডিং,মিল-কারখাানা¬ হবে মনে হয়পিছনে বর্জ্য পড়ে আছে রফিকের ডাক শুনে পিছনে তাকায় আনিসকখন যে উঠে বাইরে যাবার জন্য জামাকাপড় পড়েছে আনিস লক্ষ্যই করেনি
সকালে আর দুপুরে মজনুর সাথে গিয়ে খেয়ে আসিসওকে বলে গেলাম
তুই কাজে যাচ্ছিস নাকি?
হুম! থাক তাহলেকিছু লাগলে,মজনুকে বলিস
ঠিক আছে যাআমার কাজের ব্যাপারে একটু খোঁজটোজ নিস
আচ্ছা
রফিকের যাবার পথের দিকে তাকিয়ে থাকে আনিসআনিস নিজের ভিতরে একধরনের তাড়া অনুভব করেচাকরি-টাকরির ব্যবস্থা কিছু একটা তাকে তাড়াতাড়িই করতে হবে গ্রামে মা হয়তো টেনেটুনে সংসার চালাচ্ছে কিন্তু বোনটারতো পড়ার বেতন অনন্ত তাকে দিতে হবেনাহ্, খুব তাড়াতড়ি কিছু ব্যবস্থা করেত হবেআর বাবাটাও যে কি না,হুট করে চলে গেল
আনিসের এখনো মনে পড়ে,ছোটবেলায় বাবা কাঁেধ চড়িয়ে তাকে মেলায় নিয়ে যেত মেলায় গিয়ে আরেক কান্ড,আনিসের হাত শক্ত করে ধরে থাকতএকমহুর্তেও জন্যও ছাড়ত নাফেরার সময় হাতভর্তি নানান খাবার-দাবার নিয়ে ফিরতসেই মানুষটা এখন কেবলই স্মৃতি ভাবতেই অবাক লাগে
আনিসের কাছে ঘড়ি নেইসময়টা জানা দরকারক্ষিধেয় তার চোখে ঘুম চলে আসছে কিন্তু এখনো মজনুর খবর নেইহোটেলটা আনিসের চেনাই আছেদেখেশুনে সে নিজেই চলে যেতে পারবে কিন্তু সমস্যা হল তার কাছে হোটেলে খাওয়ার মতো কোন টাকা নেই টেবিলে রাখা জগ থেকে পানি খেয়ে আনিস খাটের উপর বসলপানিটা গত রাতের,বাসি হয়েছে আনিসের বমি আসতে লাগলএমন সময় দরজা দিয়ে ঢুকল মজনুহাতে ঢাকনা দিয়ে ঢাকা একটা পে¬
আনিসের চোখ চকচক করে উঠলমজনু হাতের পে¬টটা খাটের উপর রাখেতারপর টেবিলে রাখা জগটা নিয়ে পানি আনতে দ্রুত বের হয়ে যায়
বাইরে থেকে টিউবয়েল চাপার শব্দ আসছে
খাবার পে¬টটা সামনে নিয়ে মজনু অসহায়ের মতো বসে থাকে! কি করবে বুঝতে পারে না!
পানি নিয়ে এসে মজনু গ্লাসে ঢেলে আনিসের দিকে এগিয়ে দেয়,নেন ভাইজান! হাত ধুইয়্যা নেন
আনিস যন্ত্রের মতো গ্লাস টা হাতে নিয়ে জানালাটার দিকে যায়তারপর হাত ধুয়ে এসে ভাতে হাত দেয়
সকালে এট্টু বাজারে গেছিলাম,তাই ভাত আনতে দেরি অয়া গেল!
না,না সমস্যা নাইআমি একটু বেলা কইরা যাই ভাত খাই
অ অআমিতো মনে করছি,দেরি কইরা ফালাইলাম কিনা!
আমি অহন যাইগ্যা,বাড়িতে এট্টু কাজ আছেআফনে খাইয়্যা থালি-বাটি রাইহ্যা দিয়েনদুফুরের টাইমে আসমুনে
আচ্ছা
আনিসের প্রচন্ড খিদে পেয়েছেহাতি-ঘোড়া টাইপের ক্ষুধাকিন্তু এতোক্ষন সামনে মজনু থাকার কারনে ভালভাবে খেতে পারেনিমজনু চলে যাবার পর আনিস এখন রাক্ষসের মতো খাচ্ছেমাছের তরকারিটা মারাতœক ঝাল হয়েছেলালা এসে আনিসের জিভ ভারী হয়ে যাচ্ছেপানি খেয়েও কাজ হচ্ছে নাখাবারটা তাড়াতাড়ি শেষ করে আনিস জিভটা বাইরে বের করে বসে রইলএ অবস্থায় তাকে কেউ দেখলে বিচ্ছিরি কান্ড হয়ে যাবে
একটু ঝিরিয়ে নিয়ে আনিস বাইরে বের হয়বিল্ডিংটায় মনে হয় তেমন লোক নেই,থাকলে সে দেখতআজকেও সেই লোকটা চেয়ার পেতে বসে আছেখালি গালোকটাকে দেখে আনিস কোন কারন ছাড়াই অস্বস্তি বোধ করতে লাগলআনিস লোকটার পাশ দিয়েই হেটে গেললোকটা কিছু বলল নামাথা উচু করে একবার দেখে আবার অন্যদিকে তাকিয়ে রইল
গলিটা বরাবর ফাঁকা কোন লোক নেইগলি থেকে বের আনিস মেইন রোডের ফুটপাতে এসে দাঁড়ায়রাস্তায় দুএকটা রিক্সা ছাড়া তেমন গাড়ি নেই মানুষ-জনের যাতায়াতও তেমন নাএলাকাটা মনে হয শহরের বাইরেমফস্বলের গন্ধ আছে
আনিস ফুটপাত ধরে সামনে হাটতে লাগলরাস্তার পাশে স্তুপ করে ময়লা রাখা হয়েছেসেখান থেকে কটু গন্ধ আসছেকয়েকটা কুকুরও সেখানে খাবার খুজছেরোদটা হঠাৎ করে নেমে গিয়ে গুমোট গরম চলে আসলগরম ধুলো উড়ে এসে আনিসের চোখে-মুখে লাগছেহেঁটে অনেকখানি চলে এসেছে সেফেরা দরকার,তাছাড়া মনে হয় বৃষ্টি হবেবাতাসটাও থেমে গেছেপরিবেশটা একটা গুমোট ভাব ধরে আছে,আশ্চর্যরকম শান্ত হয়েগলির মুখে পৌঁছতেই আকাশ কালো হয়ে গেলঠান্ডা বাতাস বইছে আনিসের গা জুড়িয়ে আসছে
বিল্ডিংটার সামনে ফাঁকা,তখনকার সেই লোকটা নেইবিল্ডিংয়ের ভিতরে ঘুটঘুটে অন্ধকারআনিস আন্দাজে দেয়াল হাতরে হাতরে এগোতে থাকেসামনে কোন একটা ঘর থেকে ক্ষীণ আলো আসছেআনিস সেদিকে এগিয়ে যায়ঘরের ভিতরে মোম জালিয়ে মজনু বসে আছেবাতাসে মোমের আলো কেঁপে কেঁেপ উঠছেআনিসকে দেখে মজনু উঠে দাঁড়ায়
জোর বৃষ্টি অনব মনে অয়?
হুম
ঘুরতে গেছিলেন মনে অয়?
না,মানে একটু বাইরে দেখে আসলাম
আলাপচারিতায় সুবিধা করেতে না পেরে মজনু উঠে পড়েমোমটা টেবিলের উপর রাখেতারপর যতগুলো সম্ভব দাঁত বের করে একটা বিস্তৃত হাসি দিয়ে চলে যায় আনিসের বিরক্ত লাগেশুয়ে-বসে থাকতে আর কতক্ষন ভাল লাগেবাইরে
প্রচন্ড শব্দে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছেবৃষ্টিও শুরু হয়েছে সমান তালেবৃষ্টি আর বাতাসের মাতামাতিতে সাঁ-সাাঁ করে অদ্ভুদ ধরনের শব্দ হচ্ছেআনিস জানালাটার কাছে এসে দাঁড়ায়জানালায় ঝুলানো চটটা ভিজে জবজব করছেটান দিয়ে চটটা সরিয়ে দেয় আনিসবৃষ্টির ঠান্ডা পানি এসে আনিসের চোখে-মুখে লাগছে বিদুৎের আলোয় মাঝে মাঝে সবকিছু আলোকিত হয়ে উঠছেজানালাটা ধরে আনিস সেটা মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে দেখছে রফিক ফিরল অনেক রাতেএকেবারে কাক ভেজা হয়েতখনও বৃষ্টি পড়ছে কিন্তু সকালের মতো অতো জোরেসোরে না
রফিকের হাতে কিসের যেন একটা প্যাকেট,মনে হয় খাবারেরসুন্দর ঘ্রান আসছেহাতের প্যাকেটটা বিছনার উপর রেখে রাফিক ভেজা জামা ছাড়তে লাগল খাবারের গন্ধ এসে আনিসের নাকে ধাক্কা দিচ্ছেক্ষুধায় পেটের মধ্যে নাড়িভুড়ি পাক দিয়ে উঠছেকিন্তু আনিস চুপচাপ বসে আছেরফিক কিছু না বলাতে সেও খেতে পারছে নাদোটানায় পড়ে আনিস উসখুস করছেহয়তো আনিস কে উসখুস করতে দেখেই রফিক বলল, কিরে বসে আছিস কেন? খা!
তুই খাবি না
না,আমি খেয়ে এসেছি
অ ও ও
আনিস প্যাকেটটা কাছে টেনে নিয়ে খুলে ফেলেভিতরে একটা মোটা কাগজের বাক্সবাক্সের ঢাকনাটা তুলতেই মাংসের অসাধারণ একটা গন্ধ ভেসে আসলভিতরে মাংস বিরিয়ানীএকটা সিদ্ধ ডিমও আছেউপরে গাজর-শসার সালাদ সুন্দর করে সাজানোআনিস প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে বাক্সের উপরঅনেকদিন পর আনিস খুব তুপ্তি করে খেলখাওয়ার পর এমনিতেই আনিসের মন অসম্ভব রকম ভাল হয়ে গেল মানুষ হয়ে জন্মানোর এই এক সুবিধা এরা অল্পতেই অভিভূত হয়ে যায়
রাতে রফিকের জ্বর আসলএলেবেলে ধরনের জ্বর নাগা প্রচন্ড গরম হয়ে গেল সেই সাথে শুরু হল বমিঅল্প কিছু সময়ের মধ্যেই একেবারে বিছানায় শুইয়ে দিল আনিস পড়ে গেল বিপাকেডাক্তার ডাকবে সে উপায়ও নেইএখানে কাউকে সে চেনেও না তার উপর কাছে নেই টাকাকি এক বিচ্ছিরি অবস্থা! অনেকক্ষন জলপট্টি দেয়ার পর জ্বর একটু কমল কিন্তু বমি আগের মতোইকারোরই তেমন ঘুম হলো না,সারারাত রফিক শুধু বিছানায় এপাশ ওপাশ করলসকালে মজনুর ডাকাডাকিতে ঘুম ভাঙ্গলরফিকেরও ঘুম ভেঙ্গেছেচোখ পাকা মরিচের মতো টকটকে লালএক রাতেই
মুখ অনেকখানি শুকিয়ে গেছেআনিসেরও মাথাটা ভারী হয়ে আছেরাতে তেমন ঘুম হয়নিগোসল করলে মনে হয় ভাল লাগবেআনিস গামছাটা নিয়ে গোসলখানাার দিকে যায়গোসল সেরে এসে দেখে রফিকও জামাকাপড় পড়ছে
কিরে,আজ কাজে না গেলে হয় না?
নাহ! অনেক কাজ পড়ে আছেতাছাড়া এখন অনেকটা ভাল বোধ করছিও ও তোকে তো বলাই হয়নি,আমার সাথে তোকে আজ যেতে হবে?
এখনি!
হ্যাঁরাতে বলবো কিন্তু মনেই ছিল নাএকটা কাজের ব্যাপারে কথা বলে এসেছি
ও আচ্ছা
খেয়েদেয় রফিক আর আনিস দুজনে বেরিয়ে পড়েআজকের আবহাওয়াটা সুন্দরএকদম ঝকঝকে পরিস্কারগত রাতে বৃষ্টি হয়েছে,রাস্তায় জায়গায় জায়গায় পানি জমে আছেরফিক একটা রিকশা নিলআনিসের অস্বস্তি লাগছে,সেই সাথে একটা চাপা উত্তেজনা কাজ করছেহাজারহোক নতুন কাজে যাচ্ছে!
কি কাজ? জেনেছিস কিছু?
হুম! হোটেলে।!দেখাশুনা করাব,হিসাব-টিসাব রাখবি,পারবি নাসকাল আর দুপুরের খাওয়া ওরাই দেবে
জানিসই তো,এই হিসাব-কিতাব আমার কাছে প্যাঁচের লাগে!
আরে গাধা কয়েকদিন গেলে অভ্যাস হয়ে যাবে,তাছাড়া তুইতো আর ওখানে একা নাআরও লোক থাকবে
রিকশাটা একটা মোড়ে থামালরফিক ভাড়া মিটিয়ে আনিসকে নিয়ে সামনের দিকে এগোলরাস্তার পাশে সারি সারি দোকানওরা দোকানগুলোর সামনে দিয়ে যাচ্ছে রফিক রাস্তার পাশেই একটা দোকানে ঢুকলআনিসও ওর সাথে ঢুকলএটাই হবে মনে হয়বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই,এটা হোটেলদোকানের সামনে আড়াআড়ি কাপড় টানিয়ে দেওয়া হয়েছেরোদ আর ধুলো আটকানোর জন্যহোটেলটা তেমন বড় নাসরু লম্বা লম্বি একটা ঘরসামনে একটা ছোট এলপ্যার্টানের টেবিল নিয়ে মালিক বসে ভিতরে কযেকটা সস্তা টেবিল চেয়ার বসানোপিছনের জায়গাটুকু হোটেলের রান্নাবান্নার কাজে ব্যবহার করা হয়আনিস ছাড়াও আরও দুজন কর্মচারী আছে
আনিসকে রেখে রফিক চলে গেলঅবশ্য যাবার আগে মালিকের সাথে কথা বলে সবকিছু বুঝিয়ে দিয়ে গেছেরফিককে যতই দেখছে ততই অবাক হচ্ছেরফিকের মধ্যে কর্তা কর্তা ভাব চলে এসেছেবয়সের কারনে কিনা কে জানে? ছোটবেলাতো একদম ভ্যাবদা মার্কা ছিলকেউ কিছু বললে মুখ খুলতো নাসেই মানুষটার আজ কতো পরিবর্তনসময় মানুষকে কোথায় না নিয়ে যায়!
রাতে রফিক মনে হয় একটু তাড়াতাড়িই আসলআনিস ভাত আনার জন্য রান্নাঘরে গিয়েছিল,এসে দেখে মালিকের সাথে ফিসফাস করে কথা বলছেওকে দেখে থেমে গেল
কখন আসলি?
এইতো মাত্রই,হাতের কাজ শেষ করপ্রথমদিনতো চল আজ একটু তাড়াতাড়িই বেরিয়ে পড়ি
ঠিকমতোতো সন্ধ্যাই হলো না
হোটেলের মালিক বলল,যাও নানতুন বয়স,একটু ফুর্তি-ফার্তি কর
আনিস প্রশয়ের হাসি হাসলতারপর সামনের টেবিলের উপর ভাতের গামলাটা রেখে বাইরে বের হলরফিকও পিছনে আসলআকাশ বেশ পরিস্কারতাকিয়ে থাকলে মনে হয়,আকাশে তারগুলো বিস্ময় নিয়ে পৃথিবীর দিকে চেয়ে আছে
চল আজ কোথাও থেকে বেরিয়ে আসি
মাথা খারাপ,এই রাতের বেলা কই যাবি
দূরে না,এই কাছে পিঠে কোথাওতাছাড়া আসার পর তো কোথাও যাসনি
তাই বলে এখন
আনিস মৃদু আপত্তি জানালেও রফিকের জোরাজুরির কাছে সেটা টিকল নারফিক আনিসকে নিয়ে হাটতে লাগলসকালে যে পথে এসেছিল ঠিক তার উল্টো পথেএ রাস্তায় দোকান-পাঠ নেইরাস্তার দুপাশে বাড়িগুলো অন্ধকারে ভূতের মতো দাঁড়িয়ে আছে ওরা সমানে হাঁটছেসোজাকোন সাড়াশব্দ নেইরাস্তাজুড়ে শুধু ওদের পায়ের শব্দপ্রায় মিনিট দশেক হাঁটার ওরা পর একটা ফাঁকা জাযগায় আসলওরা এখন যে জায়গায় দাঁড়িয়ে তার সামনে নদীমাথার উপর থালার মতো বিশাল একটা চাঁদ চাঁদের আলো পড়ে ঝিকমিক করছে নদীর পানিঅন্ধকারে কালো ছায়ার মতো যাতায়াত করছে নৌকাগুলোনৌকাগুলোকে স্পষ্ট দেখা না গেলেও ছইয়ে ঝুলানো হ্যারিকেন গুলোকে বেশ বোঝা যাচ্ছেঢেউয়ের তালে তালে হ্যারিকেনের আলো দোল খাচ্ছে একটা দুটা না,অসংখ্য নৌকা যাচ্ছে আলো নিয়েঅদ্ভুদ সুন্দর দৃশ্যবেশি সুন্দর দৃশ্য অনেকক্ষন দেখা যায় রা,চোখ জ্বালা করেচোখ ফিরিয়ে নিল আনিস পাশেই ফেলে রাখা একটা ব¬কে বসে পড়েছে রফিক
জায়গাটা সুন্দর
শুধু সুন্দর না,মারাতœক সুন্দর
প্রায়ই আসিস নাকি?
না,প্রথম দিকে খুব আসতামএখন আর তেমন আসা হয় নাআনিস বেশ কয়েকদিন তো হল এসেছিস,বাড়িতে কোন খোঁজ খবর নিয়েছিস
কেন? কি হয়েছে বাড়িতেউৎকণ্ঠা ঝরে পড়ে আনিসের কন্ঠে
আরে ভয় পাচ্ছিস কেন! তোর মা খবর দিয়েছিল তার শরীরটা নাকি হঠাৎ খারাপ করেছেযা না,ঘুরে আয় একবারচাকরিতো এখন ঠিকি হয়ে গেছে
কার কাছে শুনলি?
চিঠি পাঠিয়েছিলসকালে পেয়েছিআমি হোটেলে বলে এসেছি,ওদিকে সমস্যা নেইসব ব্যবস্থা করে দিব,কাল সকালে রওনা হয়ে যা
উঠে দাড়াঁয় রফিক,চল যাওয়া যাকঅনেকক্ষন হল এসেছিআনিসও রফিককে যন্ত্রের মতো অনুসরন করেপরিবেশটা এখন আর আগের মতো ভাল লাগছে নাকোথায় যেন সুরটা কেটে গেছে
সারারাত আনিসের ঘুম হলো ছাড়াছাড়া ভাবেখুব সকালে বিছানা ছাড়ল,একেবারে অন্ধকার থাকতে থাকতেগোসল সেরে কাপড়-চোপড় গুছিয়ে গম্ভীর হয়ে বসে রইল রফিকও আজ সকাল সকাল উঠে পড়েছেসকালে আর ওদের মধ্যে তেমন কথা হলো না বাসস্ট্যান্ডে আসল বেলা থাকতেইদোকান-পাঠ কিছু খুলেছে আর কিছু খুলি খুলি করছেলোকজন কমবাসেও তেমন ভিড় হলো নাবাসে ওঠার সময় রফিক আনিসের হাতে কিছু টাকা গুঁজে দিল
রাখ.খরচ করিসআর কাজ সেরে তাড়াতাড়িই ফিরিস
রফিকের হাত শক্ত করে ধরে বলে আনিস,বাড়িতে কি হয়েছে বলতো?
কি হবে পাগল? রফিকের গলাটা ভারী শোনালো
বাস ছেড়ে দিচ্ছেনেমে যাচ্ছে রফিকদ্রুত চোখ ঘসছেহয়তো চোখে পোকা-টোকা পড়েছেস্থির হয়ে বসে আছে আনিসবাসের গতি বাড়ছেপিছনে ফেলে যাচ্ছে আনিসের স্বপ্নের শহর ঢাকা