বাস থামতেই গরমের
একটা হলকা এসে ধাক্কা দিল আনিসকে। এতোক্ষন
গায়ে বাতাস লাগার
কারনে গরমটা তেমন বোঝা যায়নি কিন্তু এখন উত্তাপটা বেশ ভালোই টের পাচ্ছে। সামনের দিক থেকে লোকজন নেমে যাচ্ছে,আনিসও তার ব্যাগটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ায় নামার
জন্য। বাসের সিট ধরে ধরে গেটের দিকে এগিয়ে যায়।
আনিস এই প্রথম কোন বড় শহরে আসল। বছরখানেক আগে ইন্টার পাশ করে বসে আছে। গ্রামে থাকতে অবশ্য সবাই পড়ার জন্য চাপ দিচ্ছিল কিন্তু আনিস আর ও ঝামেলায় যায়নি। আনিসের ছোটবেলার বন্ধু রফিক অনেকদিন ধরেই শহরে থাকে। সেই মেট্রিকের টেস্টে ফেল করে বাড়ি থেকে পালিয়েছিল,সেই আসাতেই আসা। তার প্রায় বছরখানেক পর অবশ্য বাড়ি ফিরেছিল কিন্তু আর মন টেকাতে পারে নি। রফিক এখন ঢাকাতেই থাকে,বছরে দুএকবার বাড়িতে যায়।
আনিস ঢাকা এসেছে রফিকের কাছে। বেড়ানোর জন্য না,একেবারে পাকাপাকিভাবে থাকার জন্য। আসার আগে অবশ্য সে রফিকের ঠিকানা যোগার করেছে । কিন্তু তার আসার খবর রফিকে না জানানোটা বোকামি হয়ে গেছে। এখন এই ঠিকানা খুঁজে বের করাই মুশকিল হয়ে যাবে।
আনিস বাস থেকে নেমে রাস্তার পাশে অনেকক্ষন ধরে দাঁড়িয়ে আছে।
সে এখন মোটামুটি বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে আছে। রিক্সাওয়ালারা বেশ খানিকক্ষন তাকে নিয়ে টানাটনানি করার পর ফাঁকা মাল বুঝতে পেরে চলে গেছে। ঠিকানা লেখা কাগজটা হাতে নিয়ে সে একটা রিক্সার কাছে এগিয়ে যায়।
আনিস কাগজটা রিক্সাওয়ালার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে:
এই ঠিকানায় যেতে পারবেন?
পারমু।
কত টাকা ভাড়া?
দিয়েন ৩০ টাকা।
কথা না বাড়িয়ে আনিস রিক্সায় ওঠে। রিকশায় ওঠার সময় সে পকেটে হাত দিয়ে টাকার ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে নেয়।
আনিস বাড়ি থেকে তার জমানো ৪০০ টাকা নিয়ে বেরিয়েছিল।
তার মা অবশ্য তাকে আরও কিছু টাকা দিতে চেয়েছিল কিন্তু আনিস নেয় নি। কিভাবে নেবে,তার এখন আয়-রোজগার করে বাড়িতে টাকা দেবার কথা উল্টো তাকে মায়ের কাছ থেকে নিতে হচ্ছে! লজ্জার ব্যাপার না?
রিকশাটা তাকে একটা ঘুপচি গলির সামনে নামিয়ে দিয়ে যায়। আনিস রিকশা থেকে নেমে গলির মধ্যে এগিয়ে যায়। গলিটা চাপা। দুজন মানুষ একসাথে যাওয়া মুশকিল। গলির সাথে লাগোয়া বাড়িগুলোর দেওয়ালের রং শ্যওলা পড়ে কালচে সবুজ বর্ণ ধারন করেছে। গলির শেষ মাথায় একতলা একটা বাড়ি। বাড়ি বলতে অতিকষ্টে দাঁড়িয়ে থাকা ইট-সুরকির কংকাল।
বাড়ির সামনে কাঠের কয়েকটা চেয়ারে কিছু লোক বসে আছে। আনিস সেখানে গিয়ে কাগজটা এগিয়ে দিয়ে রফিকের কথা জিজ্ঞেস করে।
একটা লোক হাত বাড়িয়ে কাগজটা নেয়। আনিসের প্রশ্ন শুনে লোকগুলো এমনভাবে তাকায় যেন কথাটা জিজ্ঞেস করা চরম অপরাধ হয়ে গেছে। কাগজটা ফিরিয়ে দিতে দিতে লোকটা আনিসকে উপর-নীচ কয়েকবার
দেখে । তারপর গলায় ঝোলানো খিলানটা দিয়ে বিশ্রীভাবে দাঁত খিলান করতে করতে আনিসকে জিজ্ঞেস করে,রফিক কি লাগে?
আনিস কাধের ব্যাগটা ঝাঁকি দিয়ে ভালভাবে ঝুলিয়ে নিয়ে বলে,বন্ধু।
এক গ্রামে বাড়ি।
লোকাটা আনিসের পায়ের সামনে মাটিতে কয়েক দলা থুথু ফেলে বলে, অঅওও। তারপর পিছনের দিক ঘুরে ডাক দেয়,মইজন্য! বাইরে আয়। ভিতর থেকে বেটে কালো একটা লোক বেরিয়ে আসে।
লোকটা আনিসের দিকে তাকিয়ে বলে,হ্যারে রফিকের ঘরে নিয়া যা।
বেটে লোকটা আনিসকে সামনের দিকে ইশারা করে বলে,আসেন।
বেটে লোকটা আনিসকে বিল্ডিংটার ভিতরে নিয়ে যায়।
বিল্ডিংয়ের ভিতরে আলো কম। আনিসের চোখ সয়ে আসতে সময় লাগে। একটু এগিয়ে একটা দরজার সামনে গিয়ে মাজায় ঝোলানো চাবি দিয়ে দরজাটা খুলে মজনু ভিতরে প্রবেশ করে।
আনিসও মজনুর পিছনে ঘরের ভিতর ঢোকে। ঘরের ভেতরটা আরো অন্ধকার। দীর্ঘদিন ঘর বন্ধ থাকলে যেমন ভ্যাপসা গন্ধ বের হয় তেমন গন্ধ আসছে। ঘরের উওর দিকে একটা ভাঙ্গা জানালা। সেটাতে চট ঝোলানো । মজনু গিয়ে চটটা সরিয়ে দেয়,বাইরের কড়া রোদ ঘরের ভিতর প্রবেশ করে। আনিসের শরীর গরমে চিরচির করতে থাকে।
মজনু কোথায় যেন হাত দিয়ে সুইচ টিপে দেয়। মাথার উপর ক্যারক্যার শব্দে অলস ভঙ্গিতে একটা ময়লাধরা ফ্যান ঘুরতে থাকে।
দরজার সামনে গিয়ে আনিসের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে মজনু বলে,আপনে আরাম করেন। রফিক ভাই আইসা পড়বো।
মজনু চলে যাওয়ার পর আনিস তার ব্যাগটা নীচে রেখে খাটের উপর বসে। খাটটা পুরনো হলেও বিছানার চাঁদরটা সুন্দর করে বিছানো।
একদম টানটান,যেটা এ বাড়ির পরিবেশের সাথে একেবারেই যায় নাা। গরমে গায়ের জামাটা ভিজে যাচ্ছে। ফ্যানের বাতাসটাও অসহ্য লাগছে।
চোখে মুখে একটু পানি লাগালে ভাল হতো কিন্তু এখানে সে পানি পাবে কোথায়। বসে থাকতে থাকতে আনিসের ঝিমুনি এসে যায়।
শুয়ে পড়ে । শুয়ে শুয়ে কত কি মনে হয়। গরমের দুপুরে গ্রামের পুকুরে সাতার কাটার কথা মনে হয়।
তার বাবর কথাও মনে হয়,আজ বাবা থাকলে তাকে নিশ্চয়ই এখানে আসতে হতো না। গ্রামেই দাপিয়ে বেড়াতে পারত। বুকে একটা চাপা কষ্ট ভর করে। ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ে আনিস।
সন্ধ্যার দিকে আনিসের ঘুম ভাঙ্গে। ঘুম ভাঙ্গার পর কেন জানি তার নিজের কাছেই লজ্জা লাগছে। রাতে রফিকের সাথে দেখা হয়। একি চেহারা হয়েছে তার। চোখমুখ শুকিয়ে গেছে। বাল্বের টিমটিমে লালচে আলোয় ভালভাবে দেখা না গেলেও বেশ বোঝা যাচ্ছে যে,সে আগের চেয়ে অনেক শুকিয়ে গেছে। আনিসকে দেখে রফিক তেমন একটা অবাক হলো, না মনে হচ্ছে তার আসার ঘটনা প্রায় প্রতিদিনি ঘটে।
আনিসকে নিয়ে রফিক বাইরে হোটেলে খেতে যায়। হোটেলটা বেশ খানিকটা দূরে। ওরা কথা বলতে বলতে হাঁটে। রফিক গ্রামের সবার কথা জিজ্ঞেস করে। ওর মা-বাবা,বোনের কথা জিজ্ঞেস করে। রফিক মুখ হাসি হাসি করে কথা বললেও তার কন্ঠে যে আফসোস ঝরে পড়ে তা বোঝা যায়। হোটেল থেকে খেয়ে ফেরার সময় রফিক বলল,এসেছিস ভালই করেছিস। তোর কোন চিন্তা নেই। আরামে খাবি আর ঘুমাবি। কলেজে ভর্তি হবার ইচ্ছা থাকলেও বল,ব্যবস্থা করে দিব।
নারে,লেখাপড়া আর আমাকে দিয়ে হবে না। তুই বরং আমাকে চাকরি-বাকরি কিছু যোগাড় করে দে!
ঠিক আছে থাক কয়েকদিন,ব্যবস্থা একটা হয়ে যাবে।
আচ্ছা,তুই কি করিস?
আমার কি আর কাজের ঠিক আছে। যখন যেটা পাই,ওটাই চালিয়ে দেই।
কথা বলতে বলতে ওরা গলির ভেতর ঢুকে পড়ে। অন্ধকার হলেও রফিক বেশ তাড়াতাড়িই হাঁটছে,বোঝা গেল এ গলিতে অন্ধকারে চলাফেরায় ও বেশ অভ্যস্থ।
পরদিন খুব সকালে আনিসের ঘুম ভাঙ্গে। রফিক তখনও মরার মতো ঘুমচ্ছে। আনিস ভাঙ্গা জানালাটার কাছে এসে দাঁড়ায়। চটটা সরিয়ে বাইরে মাথা গলিয়ে দেয়। এখনও তেমন আলো ফোটেনি,চারদিকে ঝাপসা অন্ধকারে ঢেকে আছে।
আনিস কাছে পিঠে কোন বাড়ি-ঘর দেখতে পায় না। সামনে একটা পুকুর। ওপাশে কয়েকটা ছোট ছোট বিল্ডিং,মিল-কারখাানা¬ হবে মনে হয়। পিছনে বর্জ্য পড়ে আছে। রফিকের ডাক শুনে পিছনে তাকায় আনিস। কখন যে উঠে বাইরে যাবার জন্য জামাকাপড় পড়েছে আনিস লক্ষ্যই করেনি।
সকালে আর দুপুরে মজনুর সাথে গিয়ে খেয়ে আসিস। ওকে বলে গেলাম।
তুই কাজে যাচ্ছিস নাকি?
হুম! থাক তাহলে। কিছু লাগলে,মজনুকে বলিস।
ঠিক আছে যা। আমার কাজের ব্যাপারে একটু খোঁজটোজ নিস।
আচ্ছা।
রফিকের যাবার পথের দিকে তাকিয়ে থাকে আনিস। আনিস নিজের ভিতরে একধরনের তাড়া অনুভব করে। চাকরি-টাকরির ব্যবস্থা কিছু একটা তাকে তাড়াতাড়িই করতে হবে। গ্রামে মা হয়তো টেনেটুনে সংসার চালাচ্ছে কিন্তু বোনটারতো পড়ার বেতন অনন্ত তাকে দিতে হবে। নাহ্, খুব তাড়াতড়ি কিছু ব্যবস্থা করেত হবে। আর বাবাটাও যে কি না,হুট করে চলে গেল।
আনিসের এখনো মনে পড়ে,ছোটবেলায় বাবা কাঁেধ চড়িয়ে তাকে মেলায় নিয়ে যেত। মেলায় গিয়ে আরেক কান্ড,আনিসের হাত শক্ত করে ধরে থাকত। একমহুর্তেও জন্যও ছাড়ত না। ফেরার সময় হাতভর্তি নানান খাবার-দাবার নিয়ে ফিরত। সেই মানুষটা এখন কেবলই স্মৃতি ভাবতেই অবাক লাগে।
আনিসের কাছে ঘড়ি নেই। সময়টা জানা দরকার। ক্ষিধেয় তার চোখে ঘুম চলে আসছে কিন্তু এখনো মজনুর খবর নেই। হোটেলটা আনিসের চেনাই আছে। দেখেশুনে সে নিজেই চলে যেতে পারবে কিন্তু সমস্যা হল তার কাছে হোটেলে খাওয়ার মতো কোন টাকা নেই। টেবিলে রাখা জগ থেকে পানি খেয়ে আনিস খাটের উপর বসল। পানিটা গত রাতের,বাসি হয়েছে । আনিসের বমি আসতে লাগল। এমন সময় দরজা দিয়ে ঢুকল মজনু। হাতে ঢাকনা দিয়ে ঢাকা একটা পে¬ট।
আনিসের চোখ চকচক করে উঠল। মজনু হাতের পে¬টটা খাটের উপর রাখে। তারপর টেবিলে রাখা জগটা নিয়ে পানি আনতে দ্রুত বের হয়ে যায়।
বাইরে থেকে টিউবয়েল চাপার শব্দ আসছে।
খাবার পে¬টটা সামনে নিয়ে মজনু অসহায়ের মতো বসে থাকে! কি করবে বুঝতে পারে না!
পানি নিয়ে এসে মজনু গ্লাসে ঢেলে আনিসের দিকে এগিয়ে দেয়,নেন ভাইজান! হাত ধুইয়্যা নেন।
আনিস যন্ত্রের মতো গ্লাস টা হাতে নিয়ে জানালাটার দিকে যায়। তারপর হাত ধুয়ে এসে ভাতে হাত দেয়।
সকালে এট্টু বাজারে গেছিলাম,তাই ভাত আনতে দেরি অয়া গেল!
না,না সমস্যা নাই। আমি একটু বেলা কইরা যাই ভাত খাই।
অ অ। আমিতো মনে করছি,দেরি কইরা ফালাইলাম কিনা!
আমি অহন যাইগ্যা,বাড়িতে এট্টু কাজ আছে। আফনে খাইয়্যা থালি-বাটি রাইহ্যা দিয়েন। দুফুরের টাইমে আসমুনে।
আচ্ছা।
আনিসের প্রচন্ড খিদে পেয়েছে। হাতি-ঘোড়া টাইপের ক্ষুধা। কিন্তু এতোক্ষন সামনে মজনু থাকার কারনে ভালভাবে খেতে পারেনি। মজনু চলে যাবার পর আনিস এখন রাক্ষসের মতো খাচ্ছে। মাছের তরকারিটা মারাতœক ঝাল হয়েছে। লালা এসে আনিসের জিভ ভারী হয়ে যাচ্ছে। পানি খেয়েও কাজ হচ্ছে না। খাবারটা তাড়াতাড়ি শেষ করে আনিস জিভটা বাইরে বের করে বসে রইল। এ অবস্থায় তাকে কেউ দেখলে বিচ্ছিরি কান্ড হয়ে যাবে।
একটু ঝিরিয়ে নিয়ে আনিস বাইরে বের হয়। বিল্ডিংটায় মনে হয় তেমন লোক নেই,থাকলে সে দেখত। আজকেও সেই লোকটা চেয়ার পেতে বসে আছে। খালি গা। লোকটাকে দেখে আনিস কোন কারন ছাড়াই অস্বস্তি বোধ করতে লাগল। আনিস লোকটার পাশ দিয়েই হেটে গেল। লোকটা কিছু বলল না। মাথা উচু করে একবার দেখে আবার অন্যদিকে তাকিয়ে রইল।
গলিটা বরাবর ফাঁকা । কোন লোক নেই। গলি থেকে বের আনিস মেইন রোডের ফুটপাতে এসে দাঁড়ায়। রাস্তায় দু’একটা রিক্সা ছাড়া তেমন গাড়ি নেই। মানুষ-জনের যাতায়াতও তেমন না। এলাকাটা মনে হয শহরের বাইরে। মফস্বলের গন্ধ আছে।
আনিস ফুটপাত ধরে সামনে হাটতে লাগল। রাস্তার পাশে স্তুপ করে ময়লা রাখা হয়েছে। সেখান থেকে কটু গন্ধ আসছে। কয়েকটা কুকুরও সেখানে খাবার খুজছে। রোদটা হঠাৎ করে নেমে গিয়ে গুমোট গরম চলে আসল। গরম ধুলো উড়ে এসে আনিসের চোখে-মুখে লাগছে। হেঁটে অনেকখানি চলে এসেছে সে। ফেরা দরকার,তাছাড়া মনে হয় বৃষ্টি হবে। বাতাসটাও থেমে গেছে। পরিবেশটা একটা গুমোট ভাব ধরে আছে,আশ্চর্যরকম শান্ত হয়ে। গলির মুখে পৌঁছতেই আকাশ কালো হয়ে গেল। ঠান্ডা বাতাস বইছে। আনিসের গা জুড়িয়ে আসছে।
বিল্ডিংটার সামনে ফাঁকা,তখনকার সেই লোকটা নেই। বিল্ডিংয়ের ভিতরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। আনিস আন্দাজে দেয়াল হাতরে হাতরে এগোতে থাকে। সামনে কোন একটা ঘর থেকে ক্ষীণ আলো আসছে। আনিস সেদিকে এগিয়ে যায়। ঘরের ভিতরে মোম জালিয়ে মজনু বসে আছে। বাতাসে মোমের আলো কেঁপে কেঁেপ উঠছে। আনিসকে দেখে মজনু উঠে দাঁড়ায়।
জোর বৃষ্টি অনব মনে অয়?
হুম।
ঘুরতে গেছিলেন মনে অয়?
না,মানে একটু বাইরে দেখে আসলাম।
আলাপচারিতায় সুবিধা করেতে না পেরে মজনু উঠে পড়ে। মোমটা টেবিলের উপর রাখে। তারপর যতগুলো সম্ভব দাঁত বের করে একটা বিস্তৃত হাসি দিয়ে চলে যায়। আনিসের বিরক্ত লাগে। শুয়ে-বসে থাকতে আর কতক্ষন ভাল লাগে। বাইরে
প্রচন্ড শব্দে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। বৃষ্টিও শুরু হয়েছে সমান তালে। বৃষ্টি আর বাতাসের মাতামাতিতে সাঁ-সাাঁ করে অদ্ভুদ ধরনের শব্দ হচ্ছে। আনিস জানালাটার কাছে এসে দাঁড়ায়। জানালায় ঝুলানো চটটা ভিজে জবজব করছে। টান দিয়ে চটটা সরিয়ে দেয় আনিস। বৃষ্টির ঠান্ডা পানি এসে আনিসের চোখে-মুখে লাগছে। বিদুৎের আলোয় মাঝে মাঝে সবকিছু আলোকিত হয়ে উঠছে। জানালাটা ধরে আনিস সেটা মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে দেখছে ।রফিক ফিরল অনেক রাতে। একেবারে কাক ভেজা হয়ে। তখনও বৃষ্টি পড়ছে কিন্তু সকালের মতো অতো জোরেসোরে না।
রফিকের হাতে কিসের যেন একটা প্যাকেট,মনে হয় খাবারের। সুন্দর ঘ্রান আসছে। হাতের প্যাকেটটা বিছনার উপর রেখে রাফিক ভেজা জামা ছাড়তে লাগল। খাবারের গন্ধ এসে আনিসের নাকে ধাক্কা দিচ্ছে। ক্ষুধায় পেটের মধ্যে নাড়িভুড়ি পাক দিয়ে উঠছে। কিন্তু আনিস চুপচাপ বসে আছে। রফিক কিছু না বলাতে সেও খেতে পারছে না। দোটানায় পড়ে আনিস উসখুস করছে। হয়তো আনিস কে উসখুস করতে দেখেই রফিক বলল, কিরে বসে আছিস কেন? খা!
তুই খাবি না।
না,আমি খেয়ে এসেছি।
অ ও ও।
আনিস প্যাকেটটা কাছে টেনে নিয়ে খুলে ফেলে। ভিতরে একটা মোটা কাগজের বাক্স। বাক্সের ঢাকনাটা তুলতেই মাংসের অসাধারণ একটা গন্ধ ভেসে আসল। ভিতরে মাংস বিরিয়ানী। একটা সিদ্ধ ডিমও আছে। উপরে গাজর-শসার সালাদ সুন্দর করে সাজানো। আনিস প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে বাক্সের উপর। অনেকদিন পর আনিস খুব তুপ্তি করে খেল। খাওয়ার পর এমনিতেই আনিসের মন অসম্ভব রকম ভাল হয়ে গেল। মানুষ হয়ে জন্মানোর এই এক সুবিধা এরা অল্পতেই অভিভূত হয়ে যায়।
রাতে রফিকের জ্বর আসল। এলেবেলে ধরনের জ্বর না। গা প্রচন্ড গরম হয়ে গেল সেই সাথে শুরু হল বমি। অল্প কিছু সময়ের মধ্যেই একেবারে বিছানায় শুইয়ে দিল। আনিস পড়ে গেল বিপাকে। ডাক্তার ডাকবে সে উপায়ও নেই। এখানে কাউকে সে চেনেও না তার উপর কাছে নেই টাকা। কি এক বিচ্ছিরি অবস্থা! অনেকক্ষন জলপট্টি দেয়ার পর জ্বর একটু কমল কিন্তু বমি আগের মতোই। কারোরই তেমন ঘুম হলো না,সারারাত রফিক শুধু বিছানায় এপাশ ওপাশ করল। সকালে মজনুর ডাকাডাকিতে ঘুম ভাঙ্গল। রফিকেরও ঘুম ভেঙ্গেছে। চোখ পাকা মরিচের মতো টকটকে লাল। এক রাতেই
মুখ অনেকখানি শুকিয়ে গেছে। আনিসেরও মাথাটা ভারী হয়ে আছে। রাতে তেমন ঘুম হয়নি। গোসল করলে মনে হয় ভাল লাগবে। আনিস গামছাটা নিয়ে গোসলখানাার দিকে যায়। গোসল সেরে এসে দেখে রফিকও জামাকাপড় পড়ছে।
কিরে,আজ কাজে না গেলে হয় না?
নাহ! অনেক কাজ পড়ে আছে। তাছাড়া এখন অনেকটা ভাল বোধ করছি। ও ও তোকে তো বলাই হয়নি,আমার সাথে তোকে আজ যেতে হবে?
এখনি!
হ্যাঁ। রাতে বলবো কিন্তু মনেই ছিল না। একটা কাজের ব্যাপারে কথা বলে এসেছি।
ও আচ্ছা।
খেয়েদেয় রফিক আর আনিস দু’জনে বেরিয়ে পড়ে। আজকের আবহাওয়াটা সুন্দর। একদম ঝকঝকে পরিস্কার। গত রাতে বৃষ্টি হয়েছে,রাস্তায় জায়গায় জায়গায় পানি জমে আছে। রফিক একটা রিকশা নিল। আনিসের অস্বস্তি লাগছে,সেই সাথে একটা চাপা উত্তেজনা কাজ করছে। হাজারহোক নতুন কাজে যাচ্ছে!
কি কাজ? জেনেছিস কিছু?
হুম! হোটেলে।!দেখাশুনা করাব,হিসাব-টিসাব রাখবি,পারবি না। সকাল আর দুপুরের খাওয়া ওরাই দেবে।
জানিসই তো,এই হিসাব-কিতাব আমার কাছে প্যাঁচের লাগে!
আরে গাধা কয়েকদিন গেলে অভ্যাস হয়ে যাবে,তাছাড়া তুইতো আর ওখানে একা না। আরও লোক থাকবে।
রিকশাটা একটা মোড়ে থামাল। রফিক ভাড়া মিটিয়ে আনিসকে নিয়ে সামনের দিকে এগোল। রাস্তার পাশে সারি সারি দোকান। ওরা দোকানগুলোর সামনে দিয়ে যাচ্ছে। রফিক রাস্তার পাশেই একটা দোকানে ঢুকল। আনিসও ওর সাথে ঢুকল। এটাই হবে মনে হয়। বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই,এটা হোটেল। দোকানের সামনে আড়াআড়ি কাপড় টানিয়ে দেওয়া হয়েছে। রোদ আর ধুলো আটকানোর জন্য। হোটেলটা তেমন বড় না। সরু লম্বা লম্বি একটা ঘর। সামনে একটা ছোট এলপ্যার্টানের টেবিল নিয়ে মালিক বসে। ভিতরে কযেকটা সস্তা টেবিল চেয়ার বসানো। পিছনের জায়গাটুকু হোটেলের রান্নাবান্নার কাজে ব্যবহার করা হয়। আনিস ছাড়াও আরও দুজন কর্মচারী আছে।
আনিসকে রেখে রফিক চলে গেল। অবশ্য যাবার আগে মালিকের সাথে কথা বলে সবকিছু বুঝিয়ে দিয়ে গেছে। রফিককে যতই দেখছে ততই অবাক হচ্ছে। রফিকের মধ্যে কর্তা কর্তা ভাব চলে এসেছে। বয়সের কারনে কিনা কে জানে? ছোটবেলাতো একদম ভ্যাবদা মার্কা ছিল। কেউ কিছু বললে মুখ খুলতো না। সেই মানুষটার আজ কতো পরিবর্তন। সময় মানুষকে কোথায় না নিয়ে যায়!
রাতে রফিক মনে হয় একটু তাড়াতাড়িই আসল। আনিস ভাত আনার জন্য রান্নাঘরে গিয়েছিল,এসে দেখে মালিকের সাথে ফিসফাস করে কথা বলছে। ওকে দেখে থেমে গেল।
কখন আসলি?
এইতো মাত্রই,হাতের কাজ শেষ কর। প্রথমদিনতো চল আজ একটু তাড়াতাড়িই বেরিয়ে পড়ি।
ঠিকমতোতো সন্ধ্যাই হলো না।
হোটেলের মালিক বলল,যাও না। নতুন বয়স,একটু ফুর্তি-ফার্তি কর।
আনিস প্রশয়ের হাসি হাসল। তারপর সামনের টেবিলের উপর ভাতের গামলাটা রেখে বাইরে বের হল। রফিকও পিছনে আসল। আকাশ বেশ পরিস্কার। তাকিয়ে থাকলে মনে হয়,আকাশে তারগুলো বিস্ময় নিয়ে পৃথিবীর দিকে চেয়ে আছে।
চল আজ কোথাও থেকে বেরিয়ে আসি।
মাথা খারাপ,এই রাতের বেলা কই যাবি।
দূরে না,এই কাছে পিঠে কোথাও। তাছাড়া আসার পর তো কোথাও যাসনি।
তাই বলে এখন।
আনিস মৃদু আপত্তি জানালেও রফিকের জোরাজুরির কাছে সেটা টিকল না। রফিক আনিসকে নিয়ে হাটতে লাগল। সকালে যে পথে এসেছিল ঠিক তার উল্টো পথে। এ রাস্তায় দোকান-পাঠ নেই। রাস্তার দু’পাশে বাড়িগুলো অন্ধকারে ভূতের মতো দাঁড়িয়ে আছে। ওরা সমানে হাঁটছে। সোজা। কোন সাড়াশব্দ নেই। রাস্তাজুড়ে শুধু ওদের পায়ের শব্দ। প্রায় মিনিট দশেক হাঁটার ওরা পর একটা ফাঁকা জাযগায় আসল। ওরা এখন যে জায়গায় দাঁড়িয়ে তার সামনে নদী। মাথার উপর থালার মতো বিশাল একটা চাঁদ। চাঁদের আলো পড়ে ঝিকমিক করছে নদীর পানি। অন্ধকারে কালো ছায়ার মতো যাতায়াত করছে নৌকাগুলো। নৌকাগুলোকে স্পষ্ট দেখা না গেলেও ছইয়ে ঝুলানো হ্যারিকেন গুলোকে বেশ বোঝা যাচ্ছে। ঢেউয়ের তালে তালে হ্যারিকেনের আলো দোল খাচ্ছে। একটা দুটা না,অসংখ্য নৌকা যাচ্ছে আলো নিয়ে। অদ্ভুদ সুন্দর দৃশ্য। বেশি সুন্দর দৃশ্য অনেকক্ষন দেখা যায় রা,চোখ জ্বালা করে। চোখ ফিরিয়ে নিল আনিস। পাশেই ফেলে রাখা একটা ব¬কে বসে পড়েছে রফিক।
জায়গাটা সুন্দর।
শুধু সুন্দর না,মারাতœক সুন্দর।
প্রায়ই আসিস নাকি?
না,প্রথম দিকে খুব আসতাম। এখন আর তেমন আসা হয় না। আনিস বেশ কয়েকদিন তো হল এসেছিস,বাড়িতে কোন খোঁজ খবর নিয়েছিস।
কেন? কি হয়েছে বাড়িতে। উৎকণ্ঠা ঝরে পড়ে আনিসের কন্ঠে।
আরে ভয় পাচ্ছিস কেন! তোর মা খবর দিয়েছিল তার শরীরটা নাকি হঠাৎ খারাপ করেছে। যা না,ঘুরে আয় একবার। চাকরিতো এখন ঠিকি হয়ে গেছে।
কার কাছে শুনলি?
চিঠি পাঠিয়েছিল। সকালে পেয়েছি। আমি হোটেলে বলে এসেছি,ওদিকে সমস্যা নেই। সব ব্যবস্থা করে দিব,কাল সকালে রওনা হয়ে যা।
উঠে দাড়াঁয় রফিক,চল যাওয়া যাক। অনেকক্ষন হল এসেছি। আনিসও রফিককে যন্ত্রের মতো অনুসরন করে। পরিবেশটা এখন আর আগের মতো ভাল লাগছে না। কোথায় যেন সুরটা কেটে গেছে।
সারারাত আনিসের ঘুম হলো ছাড়াছাড়া ভাবে। খুব সকালে বিছানা ছাড়ল,একেবারে অন্ধকার থাকতে থাকতে। গোসল সেরে কাপড়-চোপড় গুছিয়ে গম্ভীর হয়ে বসে রইল। রফিকও আজ সকাল সকাল উঠে পড়েছে। সকালে আর ওদের মধ্যে তেমন কথা হলো না। বাসস্ট্যান্ডে আসল বেলা থাকতেই। দোকান-পাঠ কিছু খুলেছে আর কিছু খুলি খুলি করছে। লোকজন কম। বাসেও তেমন ভিড় হলো না। বাসে ওঠার সময় রফিক আনিসের হাতে কিছু টাকা গুঁজে দিল।
রাখ.খরচ করিস। আর কাজ সেরে তাড়াতাড়িই ফিরিস।
রফিকের হাত শক্ত করে ধরে বলে আনিস,বাড়িতে কি হয়েছে বলতো?
কি হবে পাগল? রফিকের গলাটা ভারী শোনালো।
বাস ছেড়ে দিচ্ছে। নেমে যাচ্ছে রফিক। দ্রুত চোখ ঘসছে। হয়তো চোখে পোকা-টোকা পড়েছে। স্থির হয়ে বসে আছে আনিস। বাসের গতি বাড়ছে। পিছনে ফেলে যাচ্ছে আনিসের স্বপ্নের শহর । ঢাকা।
আনিস এই প্রথম কোন বড় শহরে আসল। বছরখানেক আগে ইন্টার পাশ করে বসে আছে। গ্রামে থাকতে অবশ্য সবাই পড়ার জন্য চাপ দিচ্ছিল কিন্তু আনিস আর ও ঝামেলায় যায়নি। আনিসের ছোটবেলার বন্ধু রফিক অনেকদিন ধরেই শহরে থাকে। সেই মেট্রিকের টেস্টে ফেল করে বাড়ি থেকে পালিয়েছিল,সেই আসাতেই আসা। তার প্রায় বছরখানেক পর অবশ্য বাড়ি ফিরেছিল কিন্তু আর মন টেকাতে পারে নি। রফিক এখন ঢাকাতেই থাকে,বছরে দুএকবার বাড়িতে যায়।
আনিস ঢাকা এসেছে রফিকের কাছে। বেড়ানোর জন্য না,একেবারে পাকাপাকিভাবে থাকার জন্য। আসার আগে অবশ্য সে রফিকের ঠিকানা যোগার করেছে । কিন্তু তার আসার খবর রফিকে না জানানোটা বোকামি হয়ে গেছে। এখন এই ঠিকানা খুঁজে বের করাই মুশকিল হয়ে যাবে।
আনিস বাস থেকে নেমে রাস্তার পাশে অনেকক্ষন ধরে দাঁড়িয়ে আছে।
সে এখন মোটামুটি বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে আছে। রিক্সাওয়ালারা বেশ খানিকক্ষন তাকে নিয়ে টানাটনানি করার পর ফাঁকা মাল বুঝতে পেরে চলে গেছে। ঠিকানা লেখা কাগজটা হাতে নিয়ে সে একটা রিক্সার কাছে এগিয়ে যায়।
আনিস কাগজটা রিক্সাওয়ালার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে:
এই ঠিকানায় যেতে পারবেন?
পারমু।
কত টাকা ভাড়া?
দিয়েন ৩০ টাকা।
কথা না বাড়িয়ে আনিস রিক্সায় ওঠে। রিকশায় ওঠার সময় সে পকেটে হাত দিয়ে টাকার ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে নেয়।
আনিস বাড়ি থেকে তার জমানো ৪০০ টাকা নিয়ে বেরিয়েছিল।
তার মা অবশ্য তাকে আরও কিছু টাকা দিতে চেয়েছিল কিন্তু আনিস নেয় নি। কিভাবে নেবে,তার এখন আয়-রোজগার করে বাড়িতে টাকা দেবার কথা উল্টো তাকে মায়ের কাছ থেকে নিতে হচ্ছে! লজ্জার ব্যাপার না?
রিকশাটা তাকে একটা ঘুপচি গলির সামনে নামিয়ে দিয়ে যায়। আনিস রিকশা থেকে নেমে গলির মধ্যে এগিয়ে যায়। গলিটা চাপা। দুজন মানুষ একসাথে যাওয়া মুশকিল। গলির সাথে লাগোয়া বাড়িগুলোর দেওয়ালের রং শ্যওলা পড়ে কালচে সবুজ বর্ণ ধারন করেছে। গলির শেষ মাথায় একতলা একটা বাড়ি। বাড়ি বলতে অতিকষ্টে দাঁড়িয়ে থাকা ইট-সুরকির কংকাল।
বাড়ির সামনে কাঠের কয়েকটা চেয়ারে কিছু লোক বসে আছে। আনিস সেখানে গিয়ে কাগজটা এগিয়ে দিয়ে রফিকের কথা জিজ্ঞেস করে।
একটা লোক হাত বাড়িয়ে কাগজটা নেয়। আনিসের প্রশ্ন শুনে লোকগুলো এমনভাবে তাকায় যেন কথাটা জিজ্ঞেস করা চরম অপরাধ হয়ে গেছে। কাগজটা ফিরিয়ে দিতে দিতে লোকটা আনিসকে উপর-নীচ কয়েকবার
দেখে । তারপর গলায় ঝোলানো খিলানটা দিয়ে বিশ্রীভাবে দাঁত খিলান করতে করতে আনিসকে জিজ্ঞেস করে,রফিক কি লাগে?
আনিস কাধের ব্যাগটা ঝাঁকি দিয়ে ভালভাবে ঝুলিয়ে নিয়ে বলে,বন্ধু।
এক গ্রামে বাড়ি।
লোকাটা আনিসের পায়ের সামনে মাটিতে কয়েক দলা থুথু ফেলে বলে, অঅওও। তারপর পিছনের দিক ঘুরে ডাক দেয়,মইজন্য! বাইরে আয়। ভিতর থেকে বেটে কালো একটা লোক বেরিয়ে আসে।
লোকটা আনিসের দিকে তাকিয়ে বলে,হ্যারে রফিকের ঘরে নিয়া যা।
বেটে লোকটা আনিসকে সামনের দিকে ইশারা করে বলে,আসেন।
বেটে লোকটা আনিসকে বিল্ডিংটার ভিতরে নিয়ে যায়।
বিল্ডিংয়ের ভিতরে আলো কম। আনিসের চোখ সয়ে আসতে সময় লাগে। একটু এগিয়ে একটা দরজার সামনে গিয়ে মাজায় ঝোলানো চাবি দিয়ে দরজাটা খুলে মজনু ভিতরে প্রবেশ করে।
আনিসও মজনুর পিছনে ঘরের ভিতর ঢোকে। ঘরের ভেতরটা আরো অন্ধকার। দীর্ঘদিন ঘর বন্ধ থাকলে যেমন ভ্যাপসা গন্ধ বের হয় তেমন গন্ধ আসছে। ঘরের উওর দিকে একটা ভাঙ্গা জানালা। সেটাতে চট ঝোলানো । মজনু গিয়ে চটটা সরিয়ে দেয়,বাইরের কড়া রোদ ঘরের ভিতর প্রবেশ করে। আনিসের শরীর গরমে চিরচির করতে থাকে।
মজনু কোথায় যেন হাত দিয়ে সুইচ টিপে দেয়। মাথার উপর ক্যারক্যার শব্দে অলস ভঙ্গিতে একটা ময়লাধরা ফ্যান ঘুরতে থাকে।
দরজার সামনে গিয়ে আনিসের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে মজনু বলে,আপনে আরাম করেন। রফিক ভাই আইসা পড়বো।
মজনু চলে যাওয়ার পর আনিস তার ব্যাগটা নীচে রেখে খাটের উপর বসে। খাটটা পুরনো হলেও বিছানার চাঁদরটা সুন্দর করে বিছানো।
একদম টানটান,যেটা এ বাড়ির পরিবেশের সাথে একেবারেই যায় নাা। গরমে গায়ের জামাটা ভিজে যাচ্ছে। ফ্যানের বাতাসটাও অসহ্য লাগছে।
চোখে মুখে একটু পানি লাগালে ভাল হতো কিন্তু এখানে সে পানি পাবে কোথায়। বসে থাকতে থাকতে আনিসের ঝিমুনি এসে যায়।
শুয়ে পড়ে । শুয়ে শুয়ে কত কি মনে হয়। গরমের দুপুরে গ্রামের পুকুরে সাতার কাটার কথা মনে হয়।
তার বাবর কথাও মনে হয়,আজ বাবা থাকলে তাকে নিশ্চয়ই এখানে আসতে হতো না। গ্রামেই দাপিয়ে বেড়াতে পারত। বুকে একটা চাপা কষ্ট ভর করে। ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ে আনিস।
সন্ধ্যার দিকে আনিসের ঘুম ভাঙ্গে। ঘুম ভাঙ্গার পর কেন জানি তার নিজের কাছেই লজ্জা লাগছে। রাতে রফিকের সাথে দেখা হয়। একি চেহারা হয়েছে তার। চোখমুখ শুকিয়ে গেছে। বাল্বের টিমটিমে লালচে আলোয় ভালভাবে দেখা না গেলেও বেশ বোঝা যাচ্ছে যে,সে আগের চেয়ে অনেক শুকিয়ে গেছে। আনিসকে দেখে রফিক তেমন একটা অবাক হলো, না মনে হচ্ছে তার আসার ঘটনা প্রায় প্রতিদিনি ঘটে।
আনিসকে নিয়ে রফিক বাইরে হোটেলে খেতে যায়। হোটেলটা বেশ খানিকটা দূরে। ওরা কথা বলতে বলতে হাঁটে। রফিক গ্রামের সবার কথা জিজ্ঞেস করে। ওর মা-বাবা,বোনের কথা জিজ্ঞেস করে। রফিক মুখ হাসি হাসি করে কথা বললেও তার কন্ঠে যে আফসোস ঝরে পড়ে তা বোঝা যায়। হোটেল থেকে খেয়ে ফেরার সময় রফিক বলল,এসেছিস ভালই করেছিস। তোর কোন চিন্তা নেই। আরামে খাবি আর ঘুমাবি। কলেজে ভর্তি হবার ইচ্ছা থাকলেও বল,ব্যবস্থা করে দিব।
নারে,লেখাপড়া আর আমাকে দিয়ে হবে না। তুই বরং আমাকে চাকরি-বাকরি কিছু যোগাড় করে দে!
ঠিক আছে থাক কয়েকদিন,ব্যবস্থা একটা হয়ে যাবে।
আচ্ছা,তুই কি করিস?
আমার কি আর কাজের ঠিক আছে। যখন যেটা পাই,ওটাই চালিয়ে দেই।
কথা বলতে বলতে ওরা গলির ভেতর ঢুকে পড়ে। অন্ধকার হলেও রফিক বেশ তাড়াতাড়িই হাঁটছে,বোঝা গেল এ গলিতে অন্ধকারে চলাফেরায় ও বেশ অভ্যস্থ।
পরদিন খুব সকালে আনিসের ঘুম ভাঙ্গে। রফিক তখনও মরার মতো ঘুমচ্ছে। আনিস ভাঙ্গা জানালাটার কাছে এসে দাঁড়ায়। চটটা সরিয়ে বাইরে মাথা গলিয়ে দেয়। এখনও তেমন আলো ফোটেনি,চারদিকে ঝাপসা অন্ধকারে ঢেকে আছে।
আনিস কাছে পিঠে কোন বাড়ি-ঘর দেখতে পায় না। সামনে একটা পুকুর। ওপাশে কয়েকটা ছোট ছোট বিল্ডিং,মিল-কারখাানা¬ হবে মনে হয়। পিছনে বর্জ্য পড়ে আছে। রফিকের ডাক শুনে পিছনে তাকায় আনিস। কখন যে উঠে বাইরে যাবার জন্য জামাকাপড় পড়েছে আনিস লক্ষ্যই করেনি।
সকালে আর দুপুরে মজনুর সাথে গিয়ে খেয়ে আসিস। ওকে বলে গেলাম।
তুই কাজে যাচ্ছিস নাকি?
হুম! থাক তাহলে। কিছু লাগলে,মজনুকে বলিস।
ঠিক আছে যা। আমার কাজের ব্যাপারে একটু খোঁজটোজ নিস।
আচ্ছা।
রফিকের যাবার পথের দিকে তাকিয়ে থাকে আনিস। আনিস নিজের ভিতরে একধরনের তাড়া অনুভব করে। চাকরি-টাকরির ব্যবস্থা কিছু একটা তাকে তাড়াতাড়িই করতে হবে। গ্রামে মা হয়তো টেনেটুনে সংসার চালাচ্ছে কিন্তু বোনটারতো পড়ার বেতন অনন্ত তাকে দিতে হবে। নাহ্, খুব তাড়াতড়ি কিছু ব্যবস্থা করেত হবে। আর বাবাটাও যে কি না,হুট করে চলে গেল।
আনিসের এখনো মনে পড়ে,ছোটবেলায় বাবা কাঁেধ চড়িয়ে তাকে মেলায় নিয়ে যেত। মেলায় গিয়ে আরেক কান্ড,আনিসের হাত শক্ত করে ধরে থাকত। একমহুর্তেও জন্যও ছাড়ত না। ফেরার সময় হাতভর্তি নানান খাবার-দাবার নিয়ে ফিরত। সেই মানুষটা এখন কেবলই স্মৃতি ভাবতেই অবাক লাগে।
আনিসের কাছে ঘড়ি নেই। সময়টা জানা দরকার। ক্ষিধেয় তার চোখে ঘুম চলে আসছে কিন্তু এখনো মজনুর খবর নেই। হোটেলটা আনিসের চেনাই আছে। দেখেশুনে সে নিজেই চলে যেতে পারবে কিন্তু সমস্যা হল তার কাছে হোটেলে খাওয়ার মতো কোন টাকা নেই। টেবিলে রাখা জগ থেকে পানি খেয়ে আনিস খাটের উপর বসল। পানিটা গত রাতের,বাসি হয়েছে । আনিসের বমি আসতে লাগল। এমন সময় দরজা দিয়ে ঢুকল মজনু। হাতে ঢাকনা দিয়ে ঢাকা একটা পে¬ট।
আনিসের চোখ চকচক করে উঠল। মজনু হাতের পে¬টটা খাটের উপর রাখে। তারপর টেবিলে রাখা জগটা নিয়ে পানি আনতে দ্রুত বের হয়ে যায়।
বাইরে থেকে টিউবয়েল চাপার শব্দ আসছে।
খাবার পে¬টটা সামনে নিয়ে মজনু অসহায়ের মতো বসে থাকে! কি করবে বুঝতে পারে না!
পানি নিয়ে এসে মজনু গ্লাসে ঢেলে আনিসের দিকে এগিয়ে দেয়,নেন ভাইজান! হাত ধুইয়্যা নেন।
আনিস যন্ত্রের মতো গ্লাস টা হাতে নিয়ে জানালাটার দিকে যায়। তারপর হাত ধুয়ে এসে ভাতে হাত দেয়।
সকালে এট্টু বাজারে গেছিলাম,তাই ভাত আনতে দেরি অয়া গেল!
না,না সমস্যা নাই। আমি একটু বেলা কইরা যাই ভাত খাই।
অ অ। আমিতো মনে করছি,দেরি কইরা ফালাইলাম কিনা!
আমি অহন যাইগ্যা,বাড়িতে এট্টু কাজ আছে। আফনে খাইয়্যা থালি-বাটি রাইহ্যা দিয়েন। দুফুরের টাইমে আসমুনে।
আচ্ছা।
আনিসের প্রচন্ড খিদে পেয়েছে। হাতি-ঘোড়া টাইপের ক্ষুধা। কিন্তু এতোক্ষন সামনে মজনু থাকার কারনে ভালভাবে খেতে পারেনি। মজনু চলে যাবার পর আনিস এখন রাক্ষসের মতো খাচ্ছে। মাছের তরকারিটা মারাতœক ঝাল হয়েছে। লালা এসে আনিসের জিভ ভারী হয়ে যাচ্ছে। পানি খেয়েও কাজ হচ্ছে না। খাবারটা তাড়াতাড়ি শেষ করে আনিস জিভটা বাইরে বের করে বসে রইল। এ অবস্থায় তাকে কেউ দেখলে বিচ্ছিরি কান্ড হয়ে যাবে।
একটু ঝিরিয়ে নিয়ে আনিস বাইরে বের হয়। বিল্ডিংটায় মনে হয় তেমন লোক নেই,থাকলে সে দেখত। আজকেও সেই লোকটা চেয়ার পেতে বসে আছে। খালি গা। লোকটাকে দেখে আনিস কোন কারন ছাড়াই অস্বস্তি বোধ করতে লাগল। আনিস লোকটার পাশ দিয়েই হেটে গেল। লোকটা কিছু বলল না। মাথা উচু করে একবার দেখে আবার অন্যদিকে তাকিয়ে রইল।
গলিটা বরাবর ফাঁকা । কোন লোক নেই। গলি থেকে বের আনিস মেইন রোডের ফুটপাতে এসে দাঁড়ায়। রাস্তায় দু’একটা রিক্সা ছাড়া তেমন গাড়ি নেই। মানুষ-জনের যাতায়াতও তেমন না। এলাকাটা মনে হয শহরের বাইরে। মফস্বলের গন্ধ আছে।
আনিস ফুটপাত ধরে সামনে হাটতে লাগল। রাস্তার পাশে স্তুপ করে ময়লা রাখা হয়েছে। সেখান থেকে কটু গন্ধ আসছে। কয়েকটা কুকুরও সেখানে খাবার খুজছে। রোদটা হঠাৎ করে নেমে গিয়ে গুমোট গরম চলে আসল। গরম ধুলো উড়ে এসে আনিসের চোখে-মুখে লাগছে। হেঁটে অনেকখানি চলে এসেছে সে। ফেরা দরকার,তাছাড়া মনে হয় বৃষ্টি হবে। বাতাসটাও থেমে গেছে। পরিবেশটা একটা গুমোট ভাব ধরে আছে,আশ্চর্যরকম শান্ত হয়ে। গলির মুখে পৌঁছতেই আকাশ কালো হয়ে গেল। ঠান্ডা বাতাস বইছে। আনিসের গা জুড়িয়ে আসছে।
বিল্ডিংটার সামনে ফাঁকা,তখনকার সেই লোকটা নেই। বিল্ডিংয়ের ভিতরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। আনিস আন্দাজে দেয়াল হাতরে হাতরে এগোতে থাকে। সামনে কোন একটা ঘর থেকে ক্ষীণ আলো আসছে। আনিস সেদিকে এগিয়ে যায়। ঘরের ভিতরে মোম জালিয়ে মজনু বসে আছে। বাতাসে মোমের আলো কেঁপে কেঁেপ উঠছে। আনিসকে দেখে মজনু উঠে দাঁড়ায়।
জোর বৃষ্টি অনব মনে অয়?
হুম।
ঘুরতে গেছিলেন মনে অয়?
না,মানে একটু বাইরে দেখে আসলাম।
আলাপচারিতায় সুবিধা করেতে না পেরে মজনু উঠে পড়ে। মোমটা টেবিলের উপর রাখে। তারপর যতগুলো সম্ভব দাঁত বের করে একটা বিস্তৃত হাসি দিয়ে চলে যায়। আনিসের বিরক্ত লাগে। শুয়ে-বসে থাকতে আর কতক্ষন ভাল লাগে। বাইরে
প্রচন্ড শব্দে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। বৃষ্টিও শুরু হয়েছে সমান তালে। বৃষ্টি আর বাতাসের মাতামাতিতে সাঁ-সাাঁ করে অদ্ভুদ ধরনের শব্দ হচ্ছে। আনিস জানালাটার কাছে এসে দাঁড়ায়। জানালায় ঝুলানো চটটা ভিজে জবজব করছে। টান দিয়ে চটটা সরিয়ে দেয় আনিস। বৃষ্টির ঠান্ডা পানি এসে আনিসের চোখে-মুখে লাগছে। বিদুৎের আলোয় মাঝে মাঝে সবকিছু আলোকিত হয়ে উঠছে। জানালাটা ধরে আনিস সেটা মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে দেখছে ।রফিক ফিরল অনেক রাতে। একেবারে কাক ভেজা হয়ে। তখনও বৃষ্টি পড়ছে কিন্তু সকালের মতো অতো জোরেসোরে না।
রফিকের হাতে কিসের যেন একটা প্যাকেট,মনে হয় খাবারের। সুন্দর ঘ্রান আসছে। হাতের প্যাকেটটা বিছনার উপর রেখে রাফিক ভেজা জামা ছাড়তে লাগল। খাবারের গন্ধ এসে আনিসের নাকে ধাক্কা দিচ্ছে। ক্ষুধায় পেটের মধ্যে নাড়িভুড়ি পাক দিয়ে উঠছে। কিন্তু আনিস চুপচাপ বসে আছে। রফিক কিছু না বলাতে সেও খেতে পারছে না। দোটানায় পড়ে আনিস উসখুস করছে। হয়তো আনিস কে উসখুস করতে দেখেই রফিক বলল, কিরে বসে আছিস কেন? খা!
তুই খাবি না।
না,আমি খেয়ে এসেছি।
অ ও ও।
আনিস প্যাকেটটা কাছে টেনে নিয়ে খুলে ফেলে। ভিতরে একটা মোটা কাগজের বাক্স। বাক্সের ঢাকনাটা তুলতেই মাংসের অসাধারণ একটা গন্ধ ভেসে আসল। ভিতরে মাংস বিরিয়ানী। একটা সিদ্ধ ডিমও আছে। উপরে গাজর-শসার সালাদ সুন্দর করে সাজানো। আনিস প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে বাক্সের উপর। অনেকদিন পর আনিস খুব তুপ্তি করে খেল। খাওয়ার পর এমনিতেই আনিসের মন অসম্ভব রকম ভাল হয়ে গেল। মানুষ হয়ে জন্মানোর এই এক সুবিধা এরা অল্পতেই অভিভূত হয়ে যায়।
রাতে রফিকের জ্বর আসল। এলেবেলে ধরনের জ্বর না। গা প্রচন্ড গরম হয়ে গেল সেই সাথে শুরু হল বমি। অল্প কিছু সময়ের মধ্যেই একেবারে বিছানায় শুইয়ে দিল। আনিস পড়ে গেল বিপাকে। ডাক্তার ডাকবে সে উপায়ও নেই। এখানে কাউকে সে চেনেও না তার উপর কাছে নেই টাকা। কি এক বিচ্ছিরি অবস্থা! অনেকক্ষন জলপট্টি দেয়ার পর জ্বর একটু কমল কিন্তু বমি আগের মতোই। কারোরই তেমন ঘুম হলো না,সারারাত রফিক শুধু বিছানায় এপাশ ওপাশ করল। সকালে মজনুর ডাকাডাকিতে ঘুম ভাঙ্গল। রফিকেরও ঘুম ভেঙ্গেছে। চোখ পাকা মরিচের মতো টকটকে লাল। এক রাতেই
মুখ অনেকখানি শুকিয়ে গেছে। আনিসেরও মাথাটা ভারী হয়ে আছে। রাতে তেমন ঘুম হয়নি। গোসল করলে মনে হয় ভাল লাগবে। আনিস গামছাটা নিয়ে গোসলখানাার দিকে যায়। গোসল সেরে এসে দেখে রফিকও জামাকাপড় পড়ছে।
কিরে,আজ কাজে না গেলে হয় না?
নাহ! অনেক কাজ পড়ে আছে। তাছাড়া এখন অনেকটা ভাল বোধ করছি। ও ও তোকে তো বলাই হয়নি,আমার সাথে তোকে আজ যেতে হবে?
এখনি!
হ্যাঁ। রাতে বলবো কিন্তু মনেই ছিল না। একটা কাজের ব্যাপারে কথা বলে এসেছি।
ও আচ্ছা।
খেয়েদেয় রফিক আর আনিস দু’জনে বেরিয়ে পড়ে। আজকের আবহাওয়াটা সুন্দর। একদম ঝকঝকে পরিস্কার। গত রাতে বৃষ্টি হয়েছে,রাস্তায় জায়গায় জায়গায় পানি জমে আছে। রফিক একটা রিকশা নিল। আনিসের অস্বস্তি লাগছে,সেই সাথে একটা চাপা উত্তেজনা কাজ করছে। হাজারহোক নতুন কাজে যাচ্ছে!
কি কাজ? জেনেছিস কিছু?
হুম! হোটেলে।!দেখাশুনা করাব,হিসাব-টিসাব রাখবি,পারবি না। সকাল আর দুপুরের খাওয়া ওরাই দেবে।
জানিসই তো,এই হিসাব-কিতাব আমার কাছে প্যাঁচের লাগে!
আরে গাধা কয়েকদিন গেলে অভ্যাস হয়ে যাবে,তাছাড়া তুইতো আর ওখানে একা না। আরও লোক থাকবে।
রিকশাটা একটা মোড়ে থামাল। রফিক ভাড়া মিটিয়ে আনিসকে নিয়ে সামনের দিকে এগোল। রাস্তার পাশে সারি সারি দোকান। ওরা দোকানগুলোর সামনে দিয়ে যাচ্ছে। রফিক রাস্তার পাশেই একটা দোকানে ঢুকল। আনিসও ওর সাথে ঢুকল। এটাই হবে মনে হয়। বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই,এটা হোটেল। দোকানের সামনে আড়াআড়ি কাপড় টানিয়ে দেওয়া হয়েছে। রোদ আর ধুলো আটকানোর জন্য। হোটেলটা তেমন বড় না। সরু লম্বা লম্বি একটা ঘর। সামনে একটা ছোট এলপ্যার্টানের টেবিল নিয়ে মালিক বসে। ভিতরে কযেকটা সস্তা টেবিল চেয়ার বসানো। পিছনের জায়গাটুকু হোটেলের রান্নাবান্নার কাজে ব্যবহার করা হয়। আনিস ছাড়াও আরও দুজন কর্মচারী আছে।
আনিসকে রেখে রফিক চলে গেল। অবশ্য যাবার আগে মালিকের সাথে কথা বলে সবকিছু বুঝিয়ে দিয়ে গেছে। রফিককে যতই দেখছে ততই অবাক হচ্ছে। রফিকের মধ্যে কর্তা কর্তা ভাব চলে এসেছে। বয়সের কারনে কিনা কে জানে? ছোটবেলাতো একদম ভ্যাবদা মার্কা ছিল। কেউ কিছু বললে মুখ খুলতো না। সেই মানুষটার আজ কতো পরিবর্তন। সময় মানুষকে কোথায় না নিয়ে যায়!
রাতে রফিক মনে হয় একটু তাড়াতাড়িই আসল। আনিস ভাত আনার জন্য রান্নাঘরে গিয়েছিল,এসে দেখে মালিকের সাথে ফিসফাস করে কথা বলছে। ওকে দেখে থেমে গেল।
কখন আসলি?
এইতো মাত্রই,হাতের কাজ শেষ কর। প্রথমদিনতো চল আজ একটু তাড়াতাড়িই বেরিয়ে পড়ি।
ঠিকমতোতো সন্ধ্যাই হলো না।
হোটেলের মালিক বলল,যাও না। নতুন বয়স,একটু ফুর্তি-ফার্তি কর।
আনিস প্রশয়ের হাসি হাসল। তারপর সামনের টেবিলের উপর ভাতের গামলাটা রেখে বাইরে বের হল। রফিকও পিছনে আসল। আকাশ বেশ পরিস্কার। তাকিয়ে থাকলে মনে হয়,আকাশে তারগুলো বিস্ময় নিয়ে পৃথিবীর দিকে চেয়ে আছে।
চল আজ কোথাও থেকে বেরিয়ে আসি।
মাথা খারাপ,এই রাতের বেলা কই যাবি।
দূরে না,এই কাছে পিঠে কোথাও। তাছাড়া আসার পর তো কোথাও যাসনি।
তাই বলে এখন।
আনিস মৃদু আপত্তি জানালেও রফিকের জোরাজুরির কাছে সেটা টিকল না। রফিক আনিসকে নিয়ে হাটতে লাগল। সকালে যে পথে এসেছিল ঠিক তার উল্টো পথে। এ রাস্তায় দোকান-পাঠ নেই। রাস্তার দু’পাশে বাড়িগুলো অন্ধকারে ভূতের মতো দাঁড়িয়ে আছে। ওরা সমানে হাঁটছে। সোজা। কোন সাড়াশব্দ নেই। রাস্তাজুড়ে শুধু ওদের পায়ের শব্দ। প্রায় মিনিট দশেক হাঁটার ওরা পর একটা ফাঁকা জাযগায় আসল। ওরা এখন যে জায়গায় দাঁড়িয়ে তার সামনে নদী। মাথার উপর থালার মতো বিশাল একটা চাঁদ। চাঁদের আলো পড়ে ঝিকমিক করছে নদীর পানি। অন্ধকারে কালো ছায়ার মতো যাতায়াত করছে নৌকাগুলো। নৌকাগুলোকে স্পষ্ট দেখা না গেলেও ছইয়ে ঝুলানো হ্যারিকেন গুলোকে বেশ বোঝা যাচ্ছে। ঢেউয়ের তালে তালে হ্যারিকেনের আলো দোল খাচ্ছে। একটা দুটা না,অসংখ্য নৌকা যাচ্ছে আলো নিয়ে। অদ্ভুদ সুন্দর দৃশ্য। বেশি সুন্দর দৃশ্য অনেকক্ষন দেখা যায় রা,চোখ জ্বালা করে। চোখ ফিরিয়ে নিল আনিস। পাশেই ফেলে রাখা একটা ব¬কে বসে পড়েছে রফিক।
জায়গাটা সুন্দর।
শুধু সুন্দর না,মারাতœক সুন্দর।
প্রায়ই আসিস নাকি?
না,প্রথম দিকে খুব আসতাম। এখন আর তেমন আসা হয় না। আনিস বেশ কয়েকদিন তো হল এসেছিস,বাড়িতে কোন খোঁজ খবর নিয়েছিস।
কেন? কি হয়েছে বাড়িতে। উৎকণ্ঠা ঝরে পড়ে আনিসের কন্ঠে।
আরে ভয় পাচ্ছিস কেন! তোর মা খবর দিয়েছিল তার শরীরটা নাকি হঠাৎ খারাপ করেছে। যা না,ঘুরে আয় একবার। চাকরিতো এখন ঠিকি হয়ে গেছে।
কার কাছে শুনলি?
চিঠি পাঠিয়েছিল। সকালে পেয়েছি। আমি হোটেলে বলে এসেছি,ওদিকে সমস্যা নেই। সব ব্যবস্থা করে দিব,কাল সকালে রওনা হয়ে যা।
উঠে দাড়াঁয় রফিক,চল যাওয়া যাক। অনেকক্ষন হল এসেছি। আনিসও রফিককে যন্ত্রের মতো অনুসরন করে। পরিবেশটা এখন আর আগের মতো ভাল লাগছে না। কোথায় যেন সুরটা কেটে গেছে।
সারারাত আনিসের ঘুম হলো ছাড়াছাড়া ভাবে। খুব সকালে বিছানা ছাড়ল,একেবারে অন্ধকার থাকতে থাকতে। গোসল সেরে কাপড়-চোপড় গুছিয়ে গম্ভীর হয়ে বসে রইল। রফিকও আজ সকাল সকাল উঠে পড়েছে। সকালে আর ওদের মধ্যে তেমন কথা হলো না। বাসস্ট্যান্ডে আসল বেলা থাকতেই। দোকান-পাঠ কিছু খুলেছে আর কিছু খুলি খুলি করছে। লোকজন কম। বাসেও তেমন ভিড় হলো না। বাসে ওঠার সময় রফিক আনিসের হাতে কিছু টাকা গুঁজে দিল।
রাখ.খরচ করিস। আর কাজ সেরে তাড়াতাড়িই ফিরিস।
রফিকের হাত শক্ত করে ধরে বলে আনিস,বাড়িতে কি হয়েছে বলতো?
কি হবে পাগল? রফিকের গলাটা ভারী শোনালো।
বাস ছেড়ে দিচ্ছে। নেমে যাচ্ছে রফিক। দ্রুত চোখ ঘসছে। হয়তো চোখে পোকা-টোকা পড়েছে। স্থির হয়ে বসে আছে আনিস। বাসের গতি বাড়ছে। পিছনে ফেলে যাচ্ছে আনিসের স্বপ্নের শহর । ঢাকা।
ফেসবুক- আরিফুল হক হিমেল